উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনা দেশজুড়ে শোকের ছায়া ফেলেছে। এই ট্র্যাজেডি শুধু দুর্ঘটনা নয়, আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার গভীর ত্রুটির মর্মান্তিক প্রতিফলন। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড রিসার্চ (নিটার)-এর অ্যালামনাইদের কণ্ঠে ফুটে উঠেছে শোক, ক্ষোভ ও পরিবর্তনের দাবি। নিটারের প্রতিনিধি লাবিবা সালওয়া ইসলাম এই ঘটনায় ব্যথার গভীরতা থেকে হারানো প্রাণগুলোর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে লেখাটি উৎসর্গ করেছেন।
নিটারের ৭ম ব্যাচের নাজমুক হক আহাদ বিমানবাহিনীর নিরাপত্তা ও জনকল্যাণে অঙ্গীকারের অভাব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেন, “দুর্ঘটনার তিন দিন আগে বিমানবাহিনীর বাউন্ডারি দেওয়াল ধসে একজন নিহত ও তিনজন আহত হয়েছিলেন, কিন্তু তা সংবাদে আসেনি। ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে বিশাল ক্যান্টনমেন্ট থাকলেও জনগণের প্রতি ন্যূনতম সেবা বা সচেতনতা দেখা যায় না।” তিনি জনরোষের তীর বিমানবাহিনীর অব্যবস্থাপনার দিকে নির্দেশ করেছেন।
নিটারের ৮ম ব্যাচের সোলায়মান হাওলাদার রানা প্লাজার ট্র্যাজেডির সঙ্গে তুলনা টেনে বলেন, “রানা প্লাজার পর শিল্প নিরাপত্তায় আমূল পরিবর্তন এসেছিল। মাইলস্টোনের পরও বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণে পরিবর্তন আসতে পারে। কিন্তু এই পরিবর্তন দুর্ঘটনার আগে, উপাত্তভিত্তিক হওয়া উচিত ছিল।” তিনি অপরিকল্পিত ভবন, নিষ্কাশন ও বিদ্যুৎ ব্যবস্থার ঝুঁকি কমাতে রাষ্ট্র ও নাগরিকদের সক্রিয় ভূমিকার ওপর জোর দেন।
নিটারের ৯ম ব্যাচের শান্ত মালো এই ঘটনাকে “বিবেকের মৃত্যু” বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেন, “ফেসবুকে মাইলস্টোনের খবর দেখে বিশ্বাসই হচ্ছিল না। উদ্ধার কাজ দেখতে দেখতে রানা প্লাজার স্মৃতি মনে পড়ল। দুটি ঘটনার পেছনেই অব্যবস্থাপনা।” তিনি ঢাকার কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ বিমানের উড্ডয়ন ও মেয়াদোত্তীর্ণ বিমান নিষিদ্ধ করার দাবি জানান। তার সবচেয়ে বড় ক্ষোভ: “মানুষ রক্তে ভেসে যাচ্ছিল, কিন্তু কেউ হাত বাড়ায়নি। সবাই ক্যামেরা জুম করে ভিউ আর ডলারের পেছনে ছুটেছে। আমরা মানুষ হয়েছি, কিন্তু মনুষ্যত্ব হারিয়েছি।”
নিটারের ১০ম ব্যাচের নিশাত শ্যামা সুপ্তি বলেন, “সকালটা ছিল সাধারণ। কেউ ক্লাসে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, কেউ আকাশযাত্রার রোমাঞ্চে ছিল। কিন্তু কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সব ওলটপালট—বিমানের ধ্বংসস্তূপে ছিন্নভিন্ন স্বপ্ন, নিষ্পাপ মুখ আর শিক্ষক-অভিভাবকদের নিথর দেহ।” এই ঘটনা কেবল সংবাদ নয়, একটি প্রশ্নচিহ্ন: কেন এমন হলো? কার গাফিলতি? নিরাপত্তার কী ঘাটতি ছিল? নিশাত আরো বলেন, “আমরা শুধু শ্রদ্ধা নিবেদন করছি না—আমরা চাই জবাব, দায় স্বীকার ও ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি, যেন কোনো শিক্ষা সফর মৃত্যুর সফরে রূপ না নেয়।” তিনি হারানো প্রাণের প্রতি শ্রদ্ধা ও শোকাহতদের প্রতি সহানুভূতি জানিয়ে বাকিদের দায়িত্বশীল ভূমিকার আহ্বান জানান।
মাইলস্টোনের ট্র্যাজেডি আমাদের সামনে কঠিন সত্য তুলে ধরেছে—অব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তার অভাব আমাদের ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। নিটার এলামনাই হিসেবে আমরা দাবি করছি: স্বচ্ছ তদন্ত, দায়ীদের জবাবদিহি ও ভবিষ্যত দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর পদক্ষেপ। বিমানবাহিনী তাদের প্রশিক্ষণ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা পুনর্বিবেচনা করুক। রাষ্ট্র ও সমাজ মিলে এমন ব্যবস্থা গড়ুক, যেখানে কোনো স্বপ্ন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে না।
যারা প্রাণ হারিয়েছেন, তাঁদের আত্মার শান্তি কামনা করি। শোকাহতদের প্রতি গভীর সমবেদনা। আমরা যারা বেঁচে আছি, আসুন মনুষ্যত্ব ফিরিয়ে আনি, দায়িত্ব পালন করি।