ঘড়ির কাঁটায় বেলা একটার কিছু বেশি। একটু পরই ছুটি হবে স্কুল। বাসায় ফিরে যাবে কোমলমতি শিশুরা। কিন্তু না! আর ফেরা হলো না।
বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান রাজধানীর দিয়াবাড়ির মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের এক ভবনে আছড়ে পড়ে। নিহত হন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলাম সাগর এবং ২৫ শিশু শিক্ষার্থীসহ অন্তত ৩১ জন। শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে গোটা জাতি।
জানা যায়, সোমবার (২১ জুলাই) বেলা ১টা ৬ মিনিটে প্রশিক্ষণের শেষ ধাপ সলো ট্রেইনিং ফ্লাইট সম্পন্ন করতে তৌকির কুর্মিটোলার একে খন্দকার বিমানঘাঁটি থেকে এফ-৭ যুদ্ধবিমান নিয়ে উড্ডয়ন করেন।
কিন্তু কিছুক্ষণ পরই যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বিমানটি মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দিয়াবাড়ি শাখার প্রাইমারি সেকশানের একটি ভবনে আছড়ে পড়লে আগুন ধরে যায়। এ সময়, সেখানে স্কুলটির শিক্ষক, শিক্ষার্থী, স্টাফ ও অভিভাবকেরা অবস্থান করছিলেন।
পরে সিভিল ডিফেন্স সার্ভিস, সেনাবাহিনী ও অন্যান্য উদ্ধারকর্মীরা খবর পেয়ে ছুটে যান ঘটনাস্থলে। জীবিত কয়েকজন স্কুলের শিক্ষার্থী, শিক্ষক, স্টাফ ও অভিভাবকদের উদ্ধার করার পরে একে একে বের করে আনা হয় মরদেহ।
দগ্ধদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ), জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালসহ স্থানীয় বেশ কয়েকটি হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে সেনাবাহিনীর আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ অধিদপ্তর (আইএসপিআর)।
রাষ্ট্রীয় শোক ও এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত
এ ভয়াবহ দুর্ঘটনায় মঙ্গলবার (২২ জুলাই) সারাদেশে রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করে সরকার। এ দিন সারাদেশের সকল সরকারি, আধা সরকারি ও বেসরকারি দপ্তর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়।
এ ছাড়া, সোমবার মধ্যরাতে বিমান দুর্ঘটনার কারণে ২২ ও ২৪ জুলাইয়ের চলমান এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত করার বিষয়টি নিশ্চিত করেন শিক্ষা উপদেষ্টা ড. সিআর আবরার। তার আগে, ঢাকা বোর্ডের বেশকিছু স্বনামধন্য কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দিয়ে বিবৃতি দেন।
শিক্ষা সচিবকে প্রত্যাহার
এ দিকে, বিমান দুর্ঘটনার পর থেকেই মঙ্গলবার রাষ্ট্রীয় শোক দিবস ঘোষণা করায় শিক্ষার্থীরা এইচএসসি পরীক্ষা পেছানোর দাবি জানান। কিন্তু সিদ্ধান্তহীনতার কারণে মধ্যরাতে পরীক্ষা পেছানোর কথা নিশ্চিত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
এতে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা মঙ্গলবার সকালে বাংলাদেশ সচিবালয়ের সামনে অবস্থান নিয়ে শিক্ষা উপদেষ্টা ও সচিবের পদত্যাগের দাবি জানান। পরে তারা সচিবালয়ের ফটক ভেঙে ভেতরে ঢুকে বিক্ষোভ করেন।
এ সময়, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ লাঠিচার্জ, টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করলে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হন। পরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়েরকে প্রত্যাহার করার হয়।
৫ ঘণ্টা অবরুদ্ধ আইন এবং শিক্ষা উপদেষ্টা
মঙ্গলবার (২২ জুলাই) সকাল ১০টার দিকে আইন, বিচার ও সংসদীয় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সিআর আবরার ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান।
পরিদর্শন শেষে মাইলস্টোন কলেজ থেকে বের হওয়ার সময় শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পড়েন তাঁরা।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দুর্ঘটনার পর সফলভাবে উদ্ধার, চিকিৎসা প্রদান ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে ব্যর্থ হয়েছে বলে অভিযোগ তোলেন তারা। পরে পাঁচ ঘণ্টা অবরুদ্ধ থাকার পর বেলা সাড়ে ৩টার দিকে শিক্ষার্থীরা আশ্বস্ত হলে পুলিশি নিরাপত্তায় ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন দুই উপদেষ্টা।
আহত শিশুদের পাঠানো হবে সিঙ্গাপুরে
মঙ্গলবার সকালে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে আহত শিশুদের দেখতে গিয়ে চিকিৎসকদের পরামর্শ মোতাবেক তাদের সিঙ্গাপুরে পাঠানো হবে বলে উল্লেখ করেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন।
তিনি বলেন, বুধবার সিঙ্গাপুর থেকে চিকিৎসকদের একটি দল আসার কথা রয়েছে। তাদের পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিশুকে সিঙ্গাপুরে পাঠানো হবে। বাকিদের দেশেও ট্রিটমেন্ট দেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
নিহতদের দাফনে জায়গা নির্ধারণ প্রধান উপদেষ্টার
মাইলস্টোন ট্র্যাজেডিতে প্রাণ হারানো ব্যক্তিদের দাফনের জন্য জায়গা নির্ধারণ করে দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের প্রেস উইং জানায়, বিমান বিধ্বস্ত হয়ে নিহতদের দাফনে মাইলস্টোন স্কুলের কাছে উত্তরা ১২ নম্বরের সিটি করপোরেশন কবরস্থানকে বেছে নিতে বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা।
ওই কবরস্থান মাইলস্টোন ট্র্যাজেডিতে নিহতদের স্মৃতি রক্ষার্থে সংরক্ষণ করা হবে বলেও উল্লেখ করে প্রেস উইং।
কারণ অনুসন্ধানে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের নির্দেশ
মাইলস্টোন ট্র্যাজেডির সকল কারণ অনুসন্ধানে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন উচ্চ আদালত। বিচারপতি ফাহমিদা কাদের ও সৈয়দ আহমেদ মনসুরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। হতাহতদের পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্ষতিপূরণ কেন প্রদান করা হবে না— এই মর্মে একটি রুলও জারি করা হয় ওই আদেশে।
তার পূর্বে, রাজধানীসহ দেশের সকল ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলে ত্রুটিপূর্ণ বিমান এবং যুদ্ধবিমান উড্ডয়নের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার নির্দেশনা চেয়ে রিট দায়ের করেন অ্যাডভোকেট আনিসুর রহমান রায়হান বিশ্বাস।
বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন রিটের পক্ষে এবং ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শফিকুর রহমান যথাক্রমে রাষ্ট্রপক্ষের হয়ে উক্ত রিটের শুনানিতে অংশ নেন।