মাটির মানুষ ছিলেন তিনি। গায়ে খদ্দরের পাজামা-পাঞ্জাবি, চোখেমুখে জ্বলজ্বলে সততা, আর কণ্ঠে বিদ্রোহের আগুন। একটানা সাত দশকের বেশি সময় ধরে তিনি যেভাবে সংগ্রাম করেছেন, বাংলার ইতিহাসে তেমন রাজনীতিবিদের নজির খুব কমই আছে। তিনি মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী—বাংলার মজলুম জনতার অবিসংবাদিত কণ্ঠস্বর।
শিকড়ের মানুষ, সংগ্রামের শুরু: ১৮৮০ সালে সিরাজগঞ্জ জেলার ধানগড়া গ্রামে জন্ম নেন তিনি। শৈশবেই পিতৃহারা হওয়া, দরিদ্রতা, অসচ্ছলতা—এসবই তাঁকে বাস্তব জীবনের কষাঘাতে শানিত করে তোলে। আলেম হিসেবে তাঁর শিক্ষা শুরু হয় মাদ্রাসায়, পরে চলে যান দেওবন্দে। কিন্তু তাঁর ধর্মচর্চা কখনও গোঁড়ামি হয়ে ওঠেনি—বরং তা হয়ে ওঠে মানবমুখী, সমাজনির্ভর। ধর্ম তাঁর কাছে ছিল শোষণের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর শক্তি, আর রাজনীতি ছিল সমাজ বদলের হাতিয়ার।
রাজনীতি মানেই প্রতিরোধ: ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে পাকিস্তান আমলের শোষণের বিরুদ্ধে সর্বদা সোচ্চার ছিলেন মাওলানা ভাসানী। কৃষকপ্রাণ এই নেতা পূর্ব বাংলার মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায়ে বারবার রাজপথে নেমেছেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট গঠন ও নির্বাচনে বিজয়, পরে ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনে তাঁর “আসসালামু আলাইকুম পাকিস্তান” উচ্চারণ—এটা শুধু প্রতিবাদ নয়, ছিল ভবিষ্যতের স্বাধীনতার দিকে একটি বলিষ্ঠ ইশারা।
তিনি গঠন করেছিলেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ), যা পরবর্তীকালীন প্রগতিশীল রাজনৈতিক আন্দোলনের অন্যতম ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত।
মানবতাবাদী ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তা: যদিও তিনি ছিলেন একজন ধর্মীয় নেতা, তাঁর রাজনীতি ছিল সম্পূর্ণরূপে অসাম্প্রদায়িক। ধর্মকে ব্যবহার করেননি বিভাজনের জন্য, বরং মানুষের কল্যাণের জন্য। তিনি হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকলের জন্য সমান অধিকার ও মর্যাদা চেয়েছেন। একবার বলেছিলেন,“যে রাজনীতি মানুষকে খায়, আমি সেই রাজনীতি করবো না।”
এক অনন্য উত্তরাধিকার: ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর এই জননেতা প্রয়াত হন, কিন্তু রেখে গেছেন এক অমলিন আদর্শ। আজকের বাংলাদেশে যখন নেতৃত্ব সংকট, আদর্শহীনতা, আর শোষণের রাজনীতি দেখা যায়, তখন বারবার মনে পড়ে মাওলানা ভাসানীর কথা।
তিনি ছিলেন একাধারে নেতা, দার্শনিক, বিপ্লবী ও সর্বোপরি—জনতার প্রকৃত বন্ধু। বেঁচে থাকলে হয়তো বলতেন—“আমি মরে গিয়েছি, তবু জেগে আছি তোমাদের মিছিলে, পোস্টারে, প্রতিবাদে।” মাওলানা ভাসানী কোনো পদ-পদবীর জন্য রাজনীতি করেননি। তিনি ছিলেন মানুষের জন্য রাজনীতি করা এক সাধক। ইতিহাসে এমন মানুষ বিরল, যিনি সব হারিয়ে শুধু জনতার ভালোবাসা অর্জন করে গেছেন—মাওলানা ভাসানী তেমনই এক নাম, এক প্রতীক।