আবহমানকাল থেকেই মানুষ জীবনের প্রতিটি ধাপ অতিক্রম করে আসছে যোগাযোগের মধ্য দিয়ে। এই যোগাযোগকে কেন্দ্র করেই ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে বৃহত্তর মানবসমাজ। তবে মানবসভ্যতার বিকাশের এই অন্যতম মাধ্যম যোগাযোগের মৌলিক বিষয়গুলো এখন আমাদের শিশু-কিশোররা কতটা কার্যকরভাবে রপ্ত করছে, সে বিষয়ে প্রশ্ন বিদ্যমান দীর্ঘদিন হতেই। কেননা বিবিধ কারণে ইদানিং শিশু-কিশোরদের আচরণে একে-অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করার ক্ষেত্রে যে অনাগ্রহের মাত্রা লক্ষ করা যাচ্ছে, তা সামাজিকীকরণের সুদূরপ্রসারী মনস্তাত্ত্বিক আঙ্গিকগুলোর বিকাশের জন্য একটি বড় বাধা হয়ে ধরা দিচ্ছে মনোবিদ, যোগাযোগবিদ এবং সমাজবিজ্ঞানীদের চোখে।
পাশাপাশি, তথ্য ও গণমাধ্যম সাক্ষরতার ওপরে ন্যূনতম জ্ঞান না থাকায় আমাদের দেশের তরুণ এবং শিশু-কিশোররা নানা মিথ্যা তথ্য ও গুজবের প্রসারের কারণে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছে। যা দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের পড়াশোনায় ‘যোগাযোগ অধ্যয়ন’-এর অন্তর্ভুক্তিকরণ এবং তথ্য ও গণমাধ্যম সাক্ষরতার ওপর জনসচেতনতা সৃষ্টির বিষয়ে নতুন করে ভাবনার ক্ষেত্র তৈরি করেছে। তবে সে আলোচনায় যাওয়ার পূর্বে আমাদের দেশের শিশু-কিশোরদের যোগাযোগে অনীহা প্রকাশের বা শঙ্কিত হওয়ার কারণগুলোর দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন।
সাম্প্রতিককালে বিপত্তির বিষয় হিসেবে এ ক্ষেত্রে প্রথমেই যে দিকটি সামনে আসে তা হলো— সাধারণত ডিজিটাল ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসসমূহ (বিশেষত তথ্য ও গণমাধ্যম পণ্যগুলো) ব্যবহারের জন্য প্রাপ্তবয়স্করাই সবথেকে উপযোগী হলেও, বর্তমানে আমাদের দেশের শিশু-কিশোররা দিনের অধিকাংশ সময় পার করছে এই আধুনিক প্রযুক্তির ডিভাইসগুলো ব্যবহার করে অসংখ্য অভিভাবকের অসচেতনতার কারণে। এতে করে শিশু-কিশোরদের অনেকে তথ্য ও গণমাধ্যম সাক্ষরতার কোনো জ্ঞান ছাড়াই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন ভিডিও শেয়ারিং সাইটগুলোতে ভিডিও, শর্টস ভিডিও, দেশি-বিদেশি কার্টুন ও অন্যান্য কন্টেন্ট দেখে অনায়াসে কাটিয়ে দিচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। যেগুলো কখনও ইতিবাচক, আবার কখনও নেতিবাচকভাবে প্রভাব বিস্তার করছে তাদের ওপর।
আবার কেউ কেউ মগ্ন হয়ে থাকছে কম্পিউটার কিংবা স্মার্টফোনের ভিডিও গেইমস খেলার আসক্তিতে। এর ফলে মুখোমুখি যোগাযোগের দিক থেকে এই শিশু-কিশোররা রীতিমতো মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। এমনকি অনলাইন গেইমে আসক্ত হওয়ার কারণে অনেক শিশু-কিশোরদের মধ্যে মুঠোফোনে কল এলেও, তা রিসিভ করে কথা না বলে গেইম খেলায় বুঁদ হয়ে থাকার প্রবণতাও নজরে আসছে অভিভাবকদের। অর্থাৎ অতিরিক্ত ও অযাচিত প্রযুক্তির ব্যবহার এখনকার শিশু-কিশোরদের আশঙ্কাজনকভাবে যোগাযোগবিমুখ করে তুলেছে। ফলে উদ্ভূত এ ধরনের পরিস্থিতি সামাল দিতে শিশু-কিশোরদের যোগাযোগ এবং তথ্য ও গণমাধ্যম সাক্ষরতার মৌলিক বিষয়সমূহ সম্পর্কে জ্ঞানদান করা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পাশাপাশি, এখনকার সামাজিক অবকাঠামোতে ব্যাপক হারে একক পরিবারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় যোগাযোগ দক্ষতা বৃদ্ধির স্থানগুলোতে শিশু-কিশোররা আগের তুলনায় পিছিয়ে পড়েছে। কারণ পূর্বের যৌথ পরিবারগুলোতে বাচ্চারা একসঙ্গে দাদা-দাদি, নানা-নানি এবং চাচাতো, মামাতো, খালাতো, ফুফাতো ভাই-বোনদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া বা কথোপকথনে সম্পৃক্ত হয়ে নিজেদের যোগাযোগ সক্ষমতা যেভাবে ধীরে ধীরে বৃদ্ধির সুযোগ পেত, তা এখন আর একক পরিবারে বেড়ে ওঠার মাধ্যমে পাওয়া সম্ভব নয়। এ ছাড়াও, অনেক পরিবারের অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের অন্যের সঙ্গে মিশতে কড়া বিধিনিষেধ আরোপ করে থাকেন। ফলে স্বভাবতই তাদের যোগাযোগ দক্ষতা ধীরে ধীরে কমে যায়। এর সঙ্গে অনেক সময় দেখা যায়, অভিভাবকরা নিজেরাও আলাদা আলাদাভাবে কিংবা একসঙ্গে খুবই কম কথা বলে থাকেন সন্তানদের সঙ্গে। এতে করে যোগাযোগহীনভাবে থাকতেই শিশু-কিশোররা দিন দিন অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। কিন্তু একটি সামাজিক (বা রাজনৈতিক) জীব হিসেবে মানবসন্তানদের এমন যোগাযোগবিমুখতায় অভ্যস্ত হয়ে উঠতে থাকাকে কিছুতেই শুভ লক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না।
প্রযুক্তির অপব্যবহার এবং পারিবারিক কারণ ছাড়া সামাজিক নানা কারণও শিশু-কিশোরদের যোগাযোগ স্থাপনে অনীহার সৃষ্টি করছে। পরিবারের সামাজিক অবস্থান নিয়ে হীনমন্যতা বোধ করার প্রসঙ্গটি এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। কারণ অনেক সময় দেখা যায়, একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত বা একই অঞ্চলে বসবাসরত সমবয়সী অনেক শিশু-কিশোররা উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় যুক্ত হওয়ার বিষয়টিকে এড়িয়ে যেতে চায় কিংবা কম মিথস্ক্রিয়া করে তাদের সামাজিক অবস্থানের তারতম্যের কারণে। আবার মুদ্রার অপর পিঠের কথাও বলা যেতে পারে যে, কিছু কিছু উচ্চবিত্ত শ্রেণির সন্তানরাও নিম্নবিত্ত শ্রেণির সমবয়সীদের সঙ্গে কথা বলতে ইতস্তত বোধ করে ওই সামাজিক অবস্থানের বিষয় মাথায় রেখেই। ফলে এ ধরনের মানসিকতাও শিশু-কিশোরদের যোগাযোগ দক্ষতা বৃদ্ধির প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে।
এর সঙ্গে সঙ্গে গণমাধ্যম সাক্ষরতার অভাবে বিদেশি সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বা অন্যত্র কতিপয় শিশু-কিশোরের অন্যকে বুলিং ও বডি শেইমিং করার মতো অপরাধমূলক প্রবণতা এবং আচরণও ব্যাপকভাবে ভুক্তভোগীদের যোগাযোগের ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত করছে।
তাই সার্বিকভাবে, এ বিষয়গুলো মাথায় রেখে গত বছরের নভেম্বরে নিজের ব্যক্তিগত ফেইসবুক ওয়ালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. মুসতাক আহমেদ মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি), জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে গণযোগাযোগ বা যোগাযোগ সাক্ষরতা বিষয় অন্তর্ভুক্তিকরণের জন্য উন্মুক্ত আবেদন জানিয়েছিলেন। নিঃসন্দেহে তাঁর এ আবেদনটিকে অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং যথার্থ বলে বর্ণনা করা যায়। কারণ বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়ের করাল গ্রাস থেকে রক্ষায় গঠনমূলক যোগাযোগের মৌলিক ধারণা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তথ্য ও গণমাধ্যম সাক্ষরতার মৌলিক দিকগুলো সম্পর্কে নিয়মতান্ত্রিকভাবে পাঠদানের বিষয়ে অবিলম্বে এ ধরনের যুগান্তকারী উদ্যোগ গ্রহণে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া এখন সময়ের দাবি।
লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ,বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।