সাম্প্রতিককালে একজন মার্কিন কর্মকর্তা এবং হামাসের উচ্চপদস্থ এক নেতার মধ্যকার সরাসরি আলোচনার খবর পড়ে প্রথম ইন্তিফাদার সময়ের একটি ঘটনার কথা মনে পড়লো আমার।
অধিকৃত অঞ্চলে লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমসের সাংবাদিক ড্যান ফিশারের সঙ্গে ভ্রমণ করছিলাম আমি সেই সময়। তখন ইসরায়েলি সেনারা আমাদের আটক করে। এরপরই তারা আমাদের আলাদা করে দেয়। কারণ তারা জানতো, একজন বিদেশি সাংবাদিকের সামনে তারা আমাকে হয়রানি করতে পারবে না।
তারা আমাকে ভয় দেখিয়ে কিছু চড়-থাপ্পড় মারার পরও আমি তেমন ক্ষতি ছাড়াই আমার সহকর্মীর কাছে ফিরে যেতে সক্ষম হই সেবার। তবে এই ঘটনাটি এবং এ রকম আরও কয়েকটি ঘটনার পুনরাবৃত্তি আমাকে অনুধাবন করতে শিখিয়েছে যে, দখলদার শক্তি সবসময় তাদের নিয়ন্ত্রণ অটুট রাখতে চায়। আর সেটা করতে হলে, তাদের প্রয়োজন যে কোনো তৃতীয় পক্ষকে সরিয়ে দখলদার ও দখলকৃতদের মধ্যকার সম্পর্কের ভারসাম্য অপরিবর্তিত রাখা।
এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের মতো পক্ষপাতদুষ্ট একটি বড় শক্তিও এই ধরনের সংলাপে অংশ নিলে, সেটি ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যকার সম্পর্কের অসমতা কিছুটা হলেও হ্রাস করতে পারে।
একইভাবে, ফিলিস্তিনি সাংবাদিকদের তখনই সাংবাদিক হিসেবে ইসরায়েলিরা স্বীকৃতি দেয়, যখন তারা বিদেশি গণমাধ্যমে কাজ করার সুযোগ পায়। অন্যথায়, স্থানীয় ফিলিস্তিনি গণমাধ্যমের জন্য কাজ করা কোনো সাংবাদিককে কখনোই ইসরায়েলের সরকার প্রেস কার্ড দেয় না। ইসরায়েল কীভাবে গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, সেটি এই একচেটিয়া আধিপত্যের সবচেয়ে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
এমনকি আল জাজিরাকেও কার্যত নিষিদ্ধ করা হয়েছে, যদিও একসময় তাদের আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করার অনুমোদন ছিল। ইসরায়েলের এই কঠোর গণমাধ্যমের ওপর হস্তক্ষেপের সবচেয়ে উগ্র দৃষ্টান্ত লক্ষ করা গেছে গাজার বিরুদ্ধে তাদের সামরিক অভিযান পরিচালনার সময়।
১৭ মাসেরও বেশি সময় ধরে অব্যাহত থাকা এই যুদ্ধে একজন বিদেশি সাংবাদিককেও গাজায় প্রবেশ করতে দেয়নি ইসরায়েল। উপরন্তু, যুদ্ধ চলার সময়ে প্রায় ২০০ ফিলিস্তিনি সাংবাদিককে হত্যা করেছে তারা। পাশাপাশি, যেসব ভবনগুলোতে গণমাধ্যমের অফিস রয়েছে, সেগুলোও ধ্বংস করেছে তারা। যা স্পষ্টতই ফিলিস্তিনিদের কণ্ঠ রোধ করার জন্য একটি পরিকল্পিত প্রচেষ্টা হিসেবে প্রতীয়মান হয়।
শত শত মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে রাজনীতিবিদ ও বিদেশি সংবাদমাধ্যমকে নিজেদের বর্ণনা গ্রহণ করাতে বাধ্য করছে দখলদার ইসরায়েল।
প্রচুর অর্থ ব্যয় করে বিদেশি সংবাদমাধ্যম ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের নিজেদের প্রচারণার পক্ষে নিয়ে আসতে কাজ করেছে খোদ দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এমনকি শিশুদের অগ্নিচুল্লিতে পুড়িয়ে মারা এবং গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে বলেও ভুয়া খবর হোয়াইট হাউজে ছড়িয়ে দিয়েছে তারা। পরে এসব খবর মিথ্যা প্রমাণিত হলেও তারা কোনো লজ্জা অনুভব করা তো দূরের কথা, বরং ক্ষমাও চায়নি তারা।
ইসরায়েল নির্লজ্জভাবে মিথ্যা বলে চলেছে এবং মাঠপর্যায়ের বাস্তবতাকে বিকৃত করছে। এমনকি দৃশ্যমান প্রমাণ থাকার পরও তারা অনবরত মিথ্যা বলে আসছে। মূলত গাজাজুড়ে নিজেদের যুদ্ধাপরাধকে বৈধতা দেওয়ার লক্ষ্যে বারবার বাস্তবতাকে বিকৃত করে গণমাধ্যম ও কূটনৈতিক মহলে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে দখলদাররা।
হামাসের সঙ্গে শান্তি আলোচনা নিয়েও একই কৌশলে এগোচ্ছে ইসরায়েল। হামাসের অবস্থান সম্পর্কে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে আন্তর্জাতিক জনমতকে নিজেদের পক্ষে রাখছে তারা।
তবে ইসরায়েলি জনগণ, বিশেষ করে যাদের পরিবারের সদস্যরা জিম্মি হয়েছেন, তারা বুঝতে পেরেছে যে তাদের দেশের সরকারই তাদের সঙ্গে প্রতারণা করছে। কিন্তু হোয়াইট হাউসের অনেক কর্মকর্তাসহ বেশিরভাগ মার্কিন নাগরিক যারা শুধু নির্দিষ্ট কিছু সংবাদমাধ্যমের খবর দেখেন, তারা দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলের বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণাতেই বিশ্বাস করে আসছেন।
অথচ এবার কোনো ইসরায়েলি প্রতিনিধিদের উপস্থিতি ব্যতিরেকেই হামাসের একজন ঊর্ধ্বতন নেতার সঙ্গে সরাসরি বৈঠক করে এক মার্কিন কর্মকর্তা স্বীকার করলেন যে আলোচনায় অগ্রগতি হয়েছে। তিনি এটাও স্পষ্টভাবে বললেন যে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা করছেন এবং ইসরায়েলের প্রতিনিধি নন।
এখনো এই বিষয়টি নিশ্চিত নয় যে যুক্তরাষ্ট্র ভবিষ্যতে হামাসের সঙ্গে সরাসরি আলোচনার পথ অব্যাহত রাখবে কি-না। ইতিমধ্যে ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেছেন যে এ ধরনের বৈঠকট এবারই প্রথম এবং এবারই শেষ। এর আর পুনরাবৃত্তি ঘটবে না।
তবে এই বৈঠকের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বুঝতে পেরেছে যে, ইসরায়েল কতদিন ধরে এবং কীভাবে তাদের বিভ্রান্ত করে আসছে। যদি গাজায় স্থায়ী যুদ্ধবিরতির আলোচনা ব্যাহত হয়, তাহলে হামাসের কাছে আবারও হোয়াইট হাউজ সরাসরি তাদের প্রতিনিধিদের তথ্য সংগ্রহের জন্য পাঠাতে পারে বলে মনে হয় আমার।
সার্বিকভাবে এখনও দখলকৃত অঞ্চল এবং ওয়াশিংটনের ক্ষমতার করিডোরের কাছে শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে ইসরায়েলের। কিন্তু তাদের মনে রাখা উচিত, সত্যকে চিরদিন চেপে রাখা যায় না এবং একচেটিয়া বর্ণনার এই আধিপত্য চিরকাল অটুট থাকতে পারবে না।