বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুটেক্স) ওয়েট প্রসেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও বুটেক্স শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শাকিরুল ইসলাম পিয়াসের বিরুদ্ধে তাঁর নিয়োগ নিয়ে নানা অভিযোগ উঠে এসেছে। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল ও উচ্চ মহলের সরাসরি মদদে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাব খাটানো ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি করে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে বাধ্য করার অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।
অভিযুক্ত শাকিরুল ইসলাম পিয়াস বুটেক্সের ৩৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। তিনি ২০১৩ সালে বুটেক্সের ওয়েট প্রসেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ হতে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি অর্জন করেন এবং ২০১৬ সালের ২৯ মে বুটেক্সে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। শিক্ষক নিয়োগকালীন তিনি বুটেক্স ছাত্রলীগের সাধারণত সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন। ছাত্রলীগের সাংগঠনিক দায়িত্বে থাকা অবস্থায় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের কারণে নানা ধরনের বিতর্কের জন্ম দেয়।
শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব নীতিমালা থাকলেও প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একাডেমিক ফলাফলের দিক থেকে বিভাগের প্রথম, দ্বিতীয়, অথবা পর্যায়ক্রমে শিক্ষার্থীদেরই পরবর্তীতে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেতে দেখা যায়। তবে শাকিরুল ইসলাম পিয়াসের স্নাতকের ফলাফল হতে দেখা যায় নিজ বিভাগ থেকে উত্তীর্ণ ৪৩ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে তিনি ৪২তম হয়েছেন। অর্থাৎ তিনি শেষের দিক থেকে দ্বিতীয় হয়েছেন। তাঁর সিজিপিএ ছিলো ৩.৩৩। উক্ত নিয়োগে ওয়েট প্রসেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৩৩, ৩৪ ও ৩৫তম ব্যাচের চূড়ান্ত ফলাফলে প্রথম স্থানধারীসহ মোট ১৪ জন প্রতিদ্বন্দ্বি ছিলেন। কিন্তু তাদের কাউকেই শিক্ষক হিসেবে নেওয়া হয়নি।
অভিযোগ অনুযায়ী নিয়োগের ভাইবার দিনক্ষণ ধার্য্য করা হলেও এই ভাইবা বোর্ডে শিক্ষক পিয়াসের নিয়োগ না হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হলে তিনি তাঁর অনুগত তৎকালীন ছাত্রলীগ কর্মীদের দিয়ে ক্যাম্পাসে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি করে নিয়োগ কাজে বাঁধা দেওয়ায় ভাইবার তারিখ স্থগিত করতে বাধ্য হয়। পরবর্তীতে তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক মাসউদ আহমেদের সভাপতিত্বে সাত সদস্যের ভাইবাবোর্ড গঠন করে অভিযুক্ত পিয়াসকে নিয়োগ দেওয়া হয়।
অধ্যাপক মাসউদ আহমেদকে শিক্ষক পিয়াসের নিয়োগের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, পিয়াসের নিয়োগ কীভাবে হয় সেটা সবাই জানে। ৯-১০ বছর আগের ঘটনা এটা অনেক আগের ঘটনা এটা নিয়ে এখন কথা বলে লাভ নাই। সে এখন দেশে নেই আর আমিও আর উপাচার্যের দায়িত্বে নেই, তাই আমি এখন এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাইনা। তোমরা সামনের দিকে অগ্রসর হও এবং দেখো যেন সামনে এমন কিছু না হয়।
রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে পিয়াসের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করা হলে পরবর্তীতে মেধাবী শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক যোগদানের নিরুৎসাহিত করবে এই চিন্তা থেকে অনেক শিক্ষকরা তাঁকে না নেয়ার পরামর্শ দেন। তবে ক্ষমতাবলের সামনে গোটা প্রশাসন নিরূপায় ছিল বলে জানা যায়।
ঐ সময়ের ওয়েট প্রসেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ফরহাদ হোসেন বলেন, নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় বিধায় এখানে ডিপার্টমেন্টের ভূমিকা নেই বললেই চলে, আমরা শুধু সুপারিশ করতে পারি। আমরা কেউই পিয়াসের নিয়োগের ব্যাপারে রাজি ছিলাম না। তবে এটি রাজনৈতিকভাবে একটি পূর্বনির্ধারিত বিষয়। পরিস্থিতি তখন এমন গিয়ে দাঁড়িয়েছিল যে পিয়াসকে না নেওয়া হলে অন্য কাউকে নেওয়া যাচ্ছিলো না তাই প্রশাসন তাকে নিতে বাধ্য হয়।
তৎকালীন ডিন অধ্যাপক ড. মো. জুলহাস উদ্দীনকে এ বিষয় নিয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি উপাচার্যের সাথে কথা বলতে বলেন।
এ নিয়ে বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক শাহ আলিমুজ্জান বলেন, শাকিরুল ইসলাম পিয়াসের নিয়োগকালীন সময়ে আমি প্রশাসনিক কোনো দায়িত্বে ছিলাম না। তাই সে বিষয়ে আমার মন্তব্য করা ঠিক হবে না। তবে যদি এক্ষেত্রে অনিয়মের অভিযোগ থাকে প্রশাসনিক নিয়মানুযায়ী এর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বুটেক্স ছাত্রলীগের শক্ত ভীত গড়ের তোলার নেপথ্যে নায়ক মনে করা হয় এই শাকিরুল ইসলাম পিয়াসকে। ছাত্রলীগের নেতা হিসেবে ক্যাম্পাসে টেন্ডারবাজী, নিয়োগ বাণিজ্য ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর নিপীড়নসহ আরও অনেক অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। সহকারী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পাওয়ার পর ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় হতে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জনের জন্য দেশের বাইরে যান। বিশ্ববিদ্যালয় হতে একবছরের শিক্ষাকালীন ছুটি নিয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে গেলেও এখনো দেশে ফিরেন নি তিনি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাঁর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, আমি নিয়মিত বিজ্ঞপ্তির সবগুলো যোগ্যতা ফিলআপ করে শিক্ষকের জন্য আবেদন করি এবং আমার জন্য সার্কুলারের কোনো পরিবর্তন করা হয়নি। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে যদি শিক্ষক হওয়া যেত তাহলে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক দায়িত্বে থাকা আরও অনেকে ছিলেন তারা কেন শিক্ষক হতে পারলো না। আর একজন শিক্ষক কতই বা বেতন পান, অবৈধ প্রভাব ঘাঁটানো হলে আমি তো আরও উচ্চ পদস্থ জায়গায় যেতে পারতাম। শিক্ষকতা একটি মহৎ পেশা এবং আমি সেই মহত্ত্ব উপলব্ধি করেই শিক্ষকতায় এসেছি। এক্ষেত্রে প্রশাসনকে জোরপূর্বক কোনো কাজ করানো হয়নি।
তিনি আরও বলেন, আমাদের সময় দ্বিতীয় বর্ষে ডিপার্টমেন্ট ঠিক করা হতো এবং সর্বোচ্চ মেধাবীরা ওয়েট প্রসেস ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টে পড়ার সুযোগ পেত। সে হিসেবে ওয়েট প্রসেসের সর্বশেষ শিক্ষার্থীও অন্য ডিপার্টমেন্টের টপারদের থেকে কোনো অংশে কম নয়। আমি বিশ্বাস করি ভাইবাতে আমার চেয়ে আরও অনেক যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলো। আমি মানি আমি কখনোই বলবো না আমি তাদের চেয়ে বেশি যোগ্য। তবে আল্লাহ আমার রিজিক এখানে লিখে রেখেছিলেন বলেই আমার এখানে আসা, নয়তো আমি বিসিএস অথবা আরও ভালো কোথাও যাওয়ার চেষ্টা করতাম।
তিনি ছাত্রদের উপর নির্যাতন প্রসঙ্গে বলেন, “কারো উপর আমি নির্যাতন করেছি এটা প্রমাণ করতে পারবে না কেউ। কিন্তু, যেহেতু আমি একটি সাংগঠনিক দায়িত্বে ছিলাম, ছাত্রলীগের সকলের অপকর্মের দায়ভার আমার উপর চাপানো হতো সেই প্রেক্ষিতে বর্তমানে উঠা অভিযোগগুলো সেটারই প্রতিফলন।