বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন স্বায়িত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে এ পর্যন্ত ২৪ জন উপাচার্য দায়িত্ব পালন করেছেন। সর্বশেষ জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তীতে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকীব ২৫ তম উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। সাম্প্রতিককালে বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্যদের বিরুদ্ধে শিক্ষক থেকে কর্মচারীসহ সকল নিয়োগের ক্ষেত্রেই অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিসহ নানা অভিযোগ রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) নির্দেশনা অনুযায়ী, সংস্থাটির পূর্বানুমোদন ছাড়া দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় অ্যাডহক কিংবা দৈনিক মজুরিভিত্তিক জনবল নিয়োগের সুযোগ নেই। চুক্তিভিত্তিক শিক্ষক-কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে হলে ইউজিসির নীতিমালা অনুযায়ী প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়ের রিজেন্ট বোর্ড বা সিন্ডিকেটের অনুমোদন নিতে হয়। এরপর ইউজিসির অনুমোদন সাপেক্ষে অন্তত দুটি জাতীয় দৈনিকে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে হয়। তবে সেসব নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজ ক্ষমতাবলে বিভিন্ন সময় শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়োগ দিয়ে চলেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা।
আরও পড়ুন
স্নাতকের ফলাফল ছাড়াই রাবিতে প্রথম শ্রেনির কর্মকর্তা নিয়োগ
রাবিতে মাস্টাররোল কর্মচারীদের প্রশাসন ভবন ঘেরাও
রাবি তথ্য কর্মকর্তা পদে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘পৃষ্ঠপোষক’কে নিয়োগ
২০০৪ সালে বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে উপাচার্য অধ্যাপক ফাইসুল ইসলাম ফারুকী অনিয়মের মাধ্যমে অস্থায়ীভাবে ৫৪৪ জনকে নিয়োগ দিয়েছিলেন। এই ৫৪৪ জনের চাকরি স্থায়ীকরণের আশ্বাসে তাদের নিয়োগ দেওয়া হলেও আজ ২১ বছর পরেও তারা স্থায়ীকরণের আন্দোলন করছে।
পরবর্তীতে ২০০৫ সালে অধ্যাপক আলতাফ হোসেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তারঁ বিরুদ্ধেও রয়েছে টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন পদে কর্মচারী নিয়োগের অভিযোগ। ২০০৭ সালে বাজেটে অর্থ বরাদ্দ না থাকা সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন মাত্র তিন দিনের ব্যবধানে ২০০ জন কর্মচারী নিয়োগের মাধ্যমে আলোচনায় উঠে আসে। জানা যায়, টাকার বিনিময়ে আরও ৮০০ জনকে নিয়োগের চেষ্টা করা হয় সেসময়।
ফলশ্রুতিতে ২০০৮ সালে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে অভিযুক্ত তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক আলতাফ হোসেনকে ইউজিসির শুনানিতে হাজির করা হয়।
শিক্ষক জীবনের প্রথমার্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক সোবহান ছিলেন সামনের সারির নেতৃত্বদানকারী। তবে ২০০৯ সালে তিনি প্রথমবারের মতো উপাচার্য হওয়ার স্বাদ গ্রহনের পরই শিক্ষক ও চাকরিপ্রার্থীদের করা বিভিন্ন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অধ্যাপক সোবহানের করা সব অনৈতিক কার্যক্রম প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে। নীতিকথা আর লড়াইয়ের সব রেকর্ড শুধুমাত্র অতীত স্মৃতিতে পরিণত হয়।
- উপাচার্য হিসেবে সভাপতিত্ব করা প্রথম সিন্ডিকেট সভাতেই তিনি নিজ ক্ষমতাবলে বিজ্ঞাপিত ২১টি পদের বিপরীতে ৫১ জন শিক্ষক নিয়োগের অনুমোদন দেন। ২০১৩ সালে প্রথম মেয়াদ শেষ করার আগ পর্যন্ত তিনি সর্বমোট ৩৩০ জন শিক্ষক নিয়োগ দেন, যার মধ্যে ৯৫ জনই ছিলেন দৈনিক মজুরিভিত্তিক। এছাড়া কর্মকর্তা-কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ দেন ৫৯৫ জন।
শুধু নিয়োগের অনিয়মেই তিনি সীমাবদ্ধ থাকেননি। তার বিরুদ্ধে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রকল্পের টেন্ডার প্রদানে অনিয়ম করার পাশাপাশি নিয়োগ যোগ্যতার শর্ত পূরণ করে না এমন প্রার্থীদের শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার অভিযোগ ছিল।
ইউজিসির বেতন-বাজেটের অনুমোদন ছাড়াই বিশাল নিয়োগের কারণে অধ্যাপক সোবহানের সময় বিশ্ববিদ্যালয়টি ৫০ কোটি টাকারও বেশি তহবিল ঘাটতির কবলে পড়েছিল।
অদৃশ্য কারণেই প্রথম মেয়াদে তার বিরুদ্ধে ওঠা বিভিন্ন দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগের কোনো তদন্ত হয়নি। যার ফলস্বরূপ রাবি ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ২০১৭ সালে মে মাসে দ্বিতীয় মেয়াদে আবারও উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান অধ্যাপক সোবহান।
২০১৭ সালের আগস্টে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের আদর্শ নীতিমালা পরিবর্তনের পদক্ষেপ নেন। পরিবর্তিত নীতিমালায় দেখা যায়, তিনি নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং বয়সসীমা শিথিল করেছেন।
শিথিল করা এই নিয়োগ নীতিমালাকে ব্যবহার করে ২০১৭ সালের অক্টোবরে তিনি তার জামাতা এবং মেয়েকে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন পূরন করেন, যারা কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় এবং রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হতে চেয়েও পারেননি।
শুধু জামাতা-মেয়েই নয়, পরিবর্তিত নীতিমালার কারণে অনেকেরই শিক্ষক হিসেবে চাকরির সুযোগ উন্মুক্ত হয়ে যায়। এই নীতিমালায় পরবর্তীতে ৩৪ জন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয় যারা আগের নিয়োগ নীতিমালা অনুযায়ী আবেদন করারও যোগ্য ছিলেন না।
উপাচার্য সোবহান তার দ্বিতীয় মেয়াদে এই ৩৪ জনসহ, সবমিলিয়ে ৫২ জন শিক্ষক এবং ১৯১ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছেন।
তিনি নিম্ন-স্তরের কর্মচারীদের নিয়োগের ক্ষেত্রেও বয়সসীমা বাড়িয়েছেন এবং শিক্ষাগত যোগ্যতাও কমিয়েছিলেন।
উপাচার্য হিসেবে মেয়াদের শেষ দিনে তিনি স্থাপন করেছিলেন এক নজিরবিহীন ঘটনা। এদিন সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষা করে, নিয়োগের সব শর্ত ভঙ্গ করে শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী পদে মোট ১৩৮ জনকে নিয়োগের মাধ্যমে উপাচার্য জীবনের সমাপ্তি ঘটিয়েছিলেন।
তবে হাইকোর্ট উপাচার্য সোবহানের ১৩৮ জনকে দেওয়া সব নিয়োগ স্থগিত করে। এছাড়া ২০১৭ সালের শিক্ষক নিয়োগের বিশ্ববিদ্যালয় নীতিমালাও স্থগিত করে আদালত।
২০২৪ এর জুলাই অভ্যুত্থানের পর অধ্যাপক সালেহ হাসান নকীব বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৭ তম উপাচার্যের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এখন তার বিরুদ্ধেও উঠেছে নিয়ম বহির্ভূত কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের অভিযোগ।
মোমেন খন্দকার অপি নামে এক শিক্ষার্থীকে স্নাতক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের আগেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণীর চাকরিতে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগের মাধ্যমে আলোচনায় আসেন এই উপাচার্য।
গত ১৮ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ইফতেখারুল আলম মাসুদ স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ হাসান নকীব অস্থায়ী ভিত্তিতে ওই শিক্ষার্থীকে ছয় মাসের জন্য আইসিটি সেন্টারের সহকারী প্রোগ্রামার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন।
আইসিটি সেন্টারে সহকারী প্রোগ্রামার পদে একটি অ্যাডহক নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখে প্রতিবেদন প্রণয়নের জন্য উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ফরিদ উদ্দীন খানকে সভাপতি করে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এছাড়াও, বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তরে অনুসন্ধান কাম তথ্য কর্মকর্তা পদে অ্যাডহক ভিত্তিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের ‘পৃষ্ঠপোষক’ রাশেদুল ইসলাম ওরফে রাশেদ রাজনকে নিয়োগ দেওয়া নিয়েও উপাচার্যের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ তুলেছে ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনগুলো।
ছাত্র সংগঠনগুলোর কর্মীরা এই অ্যাডহক (অস্থায়ী) নিয়োগ পদ্ধতি সংস্কার এবং অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে নিয়োগপ্রাপ্ত চারজনের নিয়োগ বাতিলের দাবি জানিয়েছেন।
এবিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকীব বলেন, ‘এখানে কোনো কোটার প্রশ্ন নেই, কোনো সমন্বয়কের প্রশ্ন নেই। তাকে যোগ্য মনে হয়েছে বলে আমরা একটা দায়িত্ব দিয়েছি। সেটা সে পালন করতে পারলে থাকবে আর পালন না করতে পারলে থাকবে না। তবে যেসব কথা বলা হচ্ছে তা ডাহা মিথ্যা কথা।
এছাড়াও, অতি সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন বিভাগ পদার্থবিজ্ঞান, গণিত এবং ফলিত রসায়ন ও রসায়ন প্রকৌশল বিভাগে ১৩ জন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে।