অনেকের কাছে সম্পূর্ণ অচেনা এক শহর রাজশাহী। আবার অনেকের কাছেই চেনাজানা। দুই পক্ষেরই রয়েছে আবাসনের অনিশ্চিয়তাসহ নানা প্রতিকূলতা। তবু এসব প্রতিকুলতা সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার একরাশ স্বপ্ন নিয়ে আসতে যেন বাধ্য তারা। আর তাদের সঙ্গ দিতে এসেছেন তাদের অভিভাবকেরা। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসা এই ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের পদচারণায় এখন মুখরিত হয়ে উঠেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস।
মঙ্গলবার (৫মার্চ) বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত ‘সি’ ইউনিটের পরীক্ষার মধ্য দিয়ে শুরু হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষা। ভর্তি পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে দুই দিন আগে থেকেই ক্যাম্পাসে ভর্তি পরীক্ষার্থীদের আগমন শুরু হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, ক্যাম্পাসের বিভিন্ন রাস্তায় যেন শুধু ভর্তিচ্ছুদের পদচারণা। প্যারিস রোড, জোহা চত্বর, শহীদ মিনার, সাবাস বাংলাদেশ চত্বর, টুকিটাকি চত্বর ও বুদ্ধিজীবী চত্বরে জমেছে ভিড়। কেউবা ব্যাগপত্র হাতে নিয়ে অপেক্ষা করছেন কোনো বড় ভাই বা আপুর জন্য। কেউবা খুঁজে দেখছেন তাদের পরীক্ষার হল। আবার অনেকেই দল বেঁধে ঘুরে দেখছেন ক্যাম্পাস। উপভোগ করছেন ক্যাম্পাসের মনোরম সৌন্দর্য। বিভিন্ন ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছেন তারা। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন আবাসিক হল, মসজিদ এবং মন্দিরেও শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অবস্থান করতে দেখা গেছে। আর সেখানে পরীক্ষার্থীরা সেরে নিচ্ছেন নিজেদের শেষ সময়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি।
খুলনা থেকে ‘সি’ ইউনিটের পরীক্ষা দিতে এসেছেন আরেফিন অমিত। তিনি বলেন, আমার বড় ভাইয়া এই ক্যাম্পাসে অধ্যায়নরত। পূর্বে একবার এই ক্যাম্পাসে এসেছিলাম ভাইয়ার সাথে। দেখেই খুব ভালো লেগেছিল। মনে একটা স্বপ্ন জেগেছিল এখানেই পড়ব। রাবিকে প্রথম পছন্দে রেখেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিয়েছি। জানি না স্বপ্ন পূরণ হবে কিনা। তবে মনেপ্রাণে চাই যেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েই ভর্তির সুযোগ হয়।
অন্যদিকে, ৬ মার্চ (বুধবার) কলা, আইন ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত (মানবিক) ‘এ’ ইউনিটের পরীক্ষার উদ্দেশ্যে তিনদিন আগে নরসিংদী থেকে ক্যাম্পাসে এসেছেন রবিউল হাসান নামের আরেক ভর্তিচ্ছু। তিনি জানান, পরীক্ষার আগের রাতে আসতে চাইলেও বাস ও ট্রেনের টিকিট না পাওয়ায় শঙ্কামুক্ত থাকতে তিনদিন আগে এসেছি। আমার এক বড় ভাই বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক হলে থাকে, আমি এখন তার রুমেই অবস্থান করছি। আমি আগে থেকেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গ্রুপে ক্যাম্পাসের ভিডিও দেখে সৌন্দর্যে মুগ্ধ হই। সেখান থেকেই আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার লেখাপড়া চালিয়ে যেতে ইচ্ছাপোষণ করি। আজ সরাসরি রাবির সৌন্দর্য দেখে আমার খুবই ভালো লেগেছে।
ঢাক থেকে আসা অনি আক্তার এক শিক্ষার্থী বলেন, আমি একজন মেয়ে তাই আমার বাবা-মা চায়না আমি এতো দূরে এসে লেখাপড়া করি। কিন্তু আমার স্বপ্ন আমি রাবিয়ান হবো। বাবা-মা কে বুঝিয়ে আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছি ভর্তি পরীক্ষা দিতে। আমি ৫,৬ ও ও ৭ মার্চ তিনটি ইউনিটে পরীক্ষা দিবো। ট্রেনের টিকেট না পেয়ে আমি বাসে করে দুইদিন আগে আমার এক ভাইয়ের বান্ধুবীর কাছে উঠি। এখন তার সাথেই আমি রাত্রিযাপন করছি। রাজশাহী এসে ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য আমার তৃষ্ণাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক পরিবেশ আমাকে মুগ্ধ করেছে। কিন্তু কিছু রিকশাওয়ালা আমাদের কাছ থেকে নির্ধারিত ভাড়া থেকে অতিরিক্ত ভাড়া দাবি করেছে।
নড়াইল থেকে সৃজন ঘোষ নামক এক ভর্তিচ্ছু পরীক্ষার ২ দিন আগেই বাবাকে নিয়ে ক্যাম্পাসে এসেছে।ওই ভর্তিচ্ছুর বাবার সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি জানান, সুদূর নড়াইল থেকে ভোর ৬টায় ছেলেকে নিয়ে ক্যাম্পাসে এসেছেন তারা। নির্ধারিত দিনে ট্রেনের টিকিট না পাওয়ায় ভোগান্তির আশঙ্কায় ২দিন আগেই চলে এসেছেন তিনি। আবাসনের অনিশ্চয়তা নিয়ে ক্যাম্পাসে আসলেও এখন তার প্রাক্তন এক ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে বলে জানান তিনি।
প্যারিস রোডের পাশে বসে থাকা এক অভিভাবক জয়নাল মিয়া বলেন,রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ আমাকে মুগ্ধ করেছে এখানের মানুষেরা খুবই আথিতেয়তাপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত আইন শৃঙ্খলা বাহিনী খুবই তৎপর রয়েছে। বিভিন্ন হেল্প ডেক্স বসেছে যা আমাদের বিভিন্ন তথ্য পেতে সহায়তা করেছে।
তিনি আরও বলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা যদি বিভিন্ন বিভাগে নেওয়া হয় তাহলে আমাদের মতো দূর-দুরান্তের মানুষদের সুবিধা হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি থেকে জানা গেছে, এবছরও ‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’ এই তিনটি ইউনিটের মাধ্যমে পরীক্ষা সম্পন্ন হবে। ‘এ’ ইউনিটে কলা, আইন, সামাজিক বিজ্ঞান ও চারুকলা অনুষদভুক্ত ২৭টি বিভাগসহ শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট অন্তর্ভুক্ত আছে। ‘বি’ ইউনিটে বিজনেস স্টাডিজ অনুষদভুক্ত ৬টি বিভাগ ও ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট এবং ‘সি’ ইউনিটে বিজ্ঞান, কৃষি, প্রকৌশল, জীববিজ্ঞান ও ভূ-বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত ২৬টি বিভাগ অন্তর্ভুক্ত আছে।
এ বছর বিশেষ কোটাসহ মোট আসন সংখ্যা ৪ হাজার ৪৩৮টি এবং কোটা বাদে আসন সংখ্যা ৩ হাজার ৯০৪টি। অর্থাৎ, এবার কোটায় ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাবেন ৫৩৪ জন শিক্ষার্থী। মোট ১ লাখ ৮৫ হাজার ৬৮০টি চূড়ান্ত আবেদন জমা হয়েছে। ‘এ’ ইউনিটে ৭৪ হাজার ৭৮৫টি, ‘বি’ ইউনিটে ৩৪ হাজার ৫৪১টি এবং ‘সি’ ইউনিটে ৭৬ হাজার ৩৫৪টি চূড়ান্ত আবেদন সম্পন্ন হয়েছে। একক আবেদনকারীর সংখ্যা ১ লাখ ৫৪ হাজার ৯৭৭। এর মধ্যে পুরুষ আবেদনকারীর সংখ্যা ৯০ হাজার ৪৫৬ এবং নারী আবেদনকারীর সংখ্যা ৬৪ হাজার ৫২১। তবে কোটা বাদে আবেদনকারীর সংখ্যা ‘এ’ ইউনিটে ৬৯ হাজার ৫২৭, ‘বি’ ইউনিটে ৩২ হাজার ৬১৪ এবং ‘সি’ ইউনিটে ৭০ হাজার ৯৭৬।
দীন ইসলাম
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়