শেখ হাসিনার স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের পতনের পর বাংলাদেশে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে সংবিধান সংস্কার ও রাষ্ট্রক্ষমতায় ভারসাম্য আনার প্রস্তাব। প্রধানমন্ত্রীর অতিরিক্ত ক্ষমতা কমিয়ে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে আলী রীয়াজের নেতৃত্বাধীন সংবিধান সংস্কার কমিশন। উদ্দেশ্য ভালো—গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, জবাবদিহি নিশ্চিতকরণ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এ সংস্কার বাস্তবে কতোটা কার্যকর হবে?
বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীই নির্বাহী বিভাগের প্রধান, আর রাষ্ট্রপতির ভূমিকা মূলত আনুষ্ঠানিক। কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি হবেন ইলেকটোরাল কলেজের মাধ্যমে নির্বাচিত এবং এনসিসির (ন্যাশনাল কনস্টিটিউশন কাউন্সিল) মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী নিয়োগের ক্ষমতা সীমিত করা হবে। কিন্তু এতে শঙ্কা দেখা দিয়েছে—ক্ষমতার ভারসাম্য আনার পরিবর্তে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও অকার্যকর সরকারব্যবস্থার সৃষ্টি হতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী যদি নিয়োগ ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা না পান, তাহলে প্রতিরক্ষা বাহিনী, অ্যাটর্নি জেনারেল কিংবা প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা তাঁর নির্দেশ মানবেন না—এটা প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলার জন্ম দিতে পারে। আবার রাষ্ট্রপতির এই অতিরিক্ত ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দুর্বৃত্তায়নের সুযোগও তৈরি হতে পারে, কারণ তিনি হবেন পরোক্ষভাবে নির্বাচিত ও জবাবদিহির বাইরের ব্যক্তি।
সংসদে স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকাররা স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারবে—এটিও দুর্নীতির সুযোগ তৈরি করবে। স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের ভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ব্যবস্থায় বিপুল অর্থ খরচ, ঘুষ ও দুর্বৃত্তায়নের ঝুঁকি বাড়বে।
অন্যদিকে, সরকারের মেয়াদ চার বছর করার প্রস্তাব উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। প্রকল্পের অনুমোদন ও বাস্তবায়নেই লেগে যায় প্রায় তিন বছর। এ সময়ে কার্যকর সরকার না থাকলে উন্নয়ন থমকে যাবে।
সবচেয়ে বড় কথা, গণতন্ত্র কেবল সাংবিধানিক কাঠামোর উপর নির্ভর করে না; এটি রাজনৈতিক সংস্কৃতি, নেতৃত্বের দায়বদ্ধতা ও জনগণের অংশগ্রহণের ফল। রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া, সব দলের সম্মিলিত অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো সংস্কারই স্থায়ী হবে না।
এই বাস্তবতায়, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য আনার প্রস্তাব যতটা না সমাধান, তার চেয়ে বেশি নতুন সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। তাই দরকার সুসংহত রাজনৈতিক ঐক্য ও বাস্তববাদী চিন্তা—না হলে “চিলের ভয়ে বিলে গিয়ে বাজপাখির খপ্পরে পড়া” ছাড়া আর কিছু হবে না।