মিয়ানমারে ২০১৭ সালে নৃশংস সামরিক অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে কয়েক লক্ষাধিক রোহিঙ্গা পার্শ্ববর্তী কয়েকটি দেশ, প্রধানত বাংলাদেশে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। একেকটি বছর যাচ্ছে, আর এই রোহিঙ্গাদের অবস্থা আরও শোচনীয় হয়ে উঠছে। গোটা বিশ্ব যখন শুধু এই মানবিক সঙ্কটের দিকে নজর দিচ্ছে, তখন রোহিঙ্গা নারী ও কিশোরী পাচারের মতো আরেকটি ভয়ঙ্কর বিষয় আড়ালেই রয়ে যাচ্ছে।
গত মাসে কালাদান প্রেস নেটওয়ার্কের রাজিয়া সুলতানা ও খিন মুয়াং রোহিঙ্গা পাচার নেটওয়ার্কের ওপর করা একটি প্রতিবেদনে এই নিগৃহীত জনগোষ্ঠীর মানুষগুলোকে কীভাবে মানবপাচারকারীরা কাজে লাগাচ্ছে তা তুলে ধরেছেন।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বেশ কয়েক বছর ধরে ক্রমবর্ধমান সীমান্ত পার হওয়ার ঘটনা মানবপাচারের নেটওয়ার্কের উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করেছে। উপরন্তু, মিয়ানমারের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত হওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কোনো আইনগত নিরাপত্তা না থাকায় এ অবস্থার কোনো উন্নতি হচ্ছে না।
স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অবহেলা বা উদাসীনতার ফলে মানবপাচার চক্রগুলো আরও সক্রিয় হয়ে উঠছে। এর সূত্রপাত ঘটছে রোহিঙ্গা নারীদের মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডসহ আশপাশের কিছু দেশে চাকরি এবং বিয়ে করিয়ে দেওয়ার প্রলোভনের মাধ্যমে। মানবপাচারকারীদের হাতে পড়ার পর কায়িক শ্রম এবং যৌনকর্মে লিপ্ত হওয়ার পাশাপাশি জোরপূর্বক বিয়েতে বাধ্য হওয়ার মধ্য দিয়ে তাদের অবস্থা হয়ে উঠছে আরও শোচনীয়।
প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গার আবাসস্থল কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোতে এই ঝুঁকি আরও বেশি। বিশেষ করে ঘনবসতিপূর্ণ শিবিরগুলোতে শিক্ষার অভাব এবং চরম দারিদ্র্যে দিনাতিপাত করা রোহিঙ্গা নারী ও কিশোরীরা উন্নত জীবনের আশায় আরও সহজে এ ধরনের ফাঁদে পা দিচ্ছেন। যা তাদেরকে সীমান্ত পেরিয়ে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে আরও দুর্বিষহ জীবনযাপনে বাধ্য করছে।
তবে পাচার হওয়ার মধ্য দিয়েই যে তাদের ভোগান্তির পরিসমাপ্তি ঘটছে, বিষয়টা এমন নয়। অধিকন্তু, কিছু কিছু ক্ষেত্রে পাচার হওয়া নারীদের ভুক্তভোগীর বদলে গণ্য করা হচ্ছে অপরাধী হিসেবে। তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে আসা নিপীড়িত ও বঞ্চিত এ সব নারী প্রায়শই গ্রেপ্তার হওয়ার আতঙ্কে থাকছেন। যা তাদের ভোগান্তি বাড়িয়ে দিচ্ছে আরও কয়েক গুন। কোনো বৈধ পরিচয় না থাকায় রাষ্ট্রহীনতা তাদের দুর্বলতাকে আরও জটিল করে তুলছে। ন্যায়বিচার বা নিরাপত্তা না পাওয়ার কারণে সহজেই পাচারকারী ও নিপীড়কদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছেন তারা।
মূলত, প্রতিটা পাচার হওয়া রোহিঙ্গা নারী নিপীড়িত মানুষদের রক্ষায় মানবতার সামগ্রিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার প্রতিনিধিত্ব করেন। রোহিঙ্গা নারী ও কিশোরীদের এই পাচারের ঘটনা নিছক কোনো ট্র্যাজেডি নয়। বরং এটি বিশ্বের অন্যতম একটি অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা নিশ্চিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ব্যর্থতার পরিচায়ক। রোহিঙ্গা সঙ্কটের প্রশস্ত শোরগোলে পাচার হওয়া এই নারীদের কণ্ঠস্বর তাই তলিয়ে যেতে পারে না। তাদের ভোগান্তির দিকে বিশ্বকে তাকাতে হবে। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে অবশ্যই অগ্রাধিকার দিতে হবে।
এমতাবস্থায়, কোনো ধরনের আইনি সুরক্ষা বা ন্যায়বিচারের অধিকার ছাড়া রোহিঙ্গা নারীদের এই ভোগান্তি আড়ালেই থেকে যাবে। কারণ, অস্তিত্ব সঙ্কটের মধ্যে দিনাতিপাত করা তাদের পরিবারগুলো এর প্রতিকারে কোনো পদক্ষেপ নিতে অক্ষম। এই নির্মম বাস্তবতা আরও তীব্র হয়ে উঠেছে শরণার্থী শিবিরগুলিতে নজরদারির কমতি এবং রোহিঙ্গা জনগণের ব্যাপক রাষ্ট্রহীনতার কারণে।
বৃহত্তর মানবিক সঙ্কটের দিকে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করার মধ্য দিয়ে এর অন্তর্নিহিত লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার দিকে না তাকিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মূলত এই নীরব মহামারিকে উপেক্ষা করছে। তাই সরকার ও মানবিক সংস্থাগুলোর উচিত এই শোষণকে একটি গুরুতর সমস্যা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া। কেননা, রোহিঙ্গা নারী ও কিশোরীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করার কারণগুলো সমাধানে সম্মিলিত উদ্যোগ না নিলে তাদের পাচার আরও বৃদ্ধি পাবে।
সর্বোপরি, রোহিঙ্গা নারীদের নিরাপত্তা ও মর্যাদা নির্ভর করছে তাৎক্ষণিক, টেকসই এবং কার্যকর পদক্ষেপের উপর। শুধু শিক্ষা, আইনি সুরক্ষা এবং অর্থনৈতিক সহায়তা নিশ্চিতই পারে তাদের এই পদ্ধতিগত সঙ্কটগুলোর সমাধান করে নির্যাতনের চক্র নির্মূলের মাধ্যমে তাদের মর্যাদা পুনরুদ্ধার করতে। তাই রোহিঙ্গা নারীদের রক্ষায় উদ্যোগী হওয়ার এখনই সময়।
• ড. আজিম ইব্রাহিম, ওয়াশিংটনভিত্তিক নিউলাইন্স ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড পলিসির স্পেশাল ইনিশিয়েটিভের পরিচালক
• আরব নিউজ থেকে সংক্ষিপ্তাকারে ভাষান্তর: রুশাইদ আহমেদ