পর্যটন নগরী হিসেবে খ্যাত মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলা ও মৌলভীবাজার জেলার সদর উপজেলার ট্রেন যাত্রীদের একমাত্র ভরসাস্থল শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে স্টেশন। মৌলভীবাজার জেলার সদর উপজেলায় রেললাইন বা রেলওয়ে স্টেশন নেই। ফলে এ উপজেলা ও শ্রীমঙ্গল উপজেলার ট্রেন যাত্রীরা শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে স্টেশন থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করে থাকেন। অন্যদিকে শ্রীমঙ্গল উপজেলা পর্যটন নগরী হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার পর থেকে গত দুই দশক ধরে প্রতিদিন হাজার হাজার দেশি-বিদেশি পর্যটন এ উপজেলার পর্যটন স্পটগুলো ভ্রমণ করেন। কিন্তু ট্রেনের টিকিট তীব্র সংকটে দুর্ভোগ পোহাতে হয় ট্রেনে ভ্রমণ-ইচ্ছুক হাজার হাজার যাত্রী। প্রায় সবগুলো টিকিটে আবার অ্যাপসের মাধ্যমে অনলাইনে কাটতে হয়। ট্রেন যাত্রার ১০ দিন আগে সকাল ৮টা থেকে অনলাইনে টিকিট বিক্রি শুরু হলেও শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে স্টেশনের জন্য বরাদ্দকৃত টিকিট কয়েক মিনিটের মধ্যে শেষ হয়ে যায়।
দীর্ঘদিন ধরে জেলাবাসী শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে স্টেশনের টিকিট বাড়ানোর দাবি জানিয়ে আসছেন। তবুও নির্বিকার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে স্টেশন সূত্রে জানা গেছে, শ্রীমঙ্গল থেকে ঢাকাগামী চারটি এবং শ্রীমঙ্গল থেকে চট্টগ্রামগামী দুই যাত্রীবাহী আন্তঃনগর ট্রেন প্রতিদিন যাতায়াত করে। ট্রেনগুলো হলো- ঢাকাগামী কালনী এক্সপ্রেস, জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস, পারাবত এক্সপ্রেস ও উপবন এক্সপ্রেস এবং চট্টগ্রামগামী পাহাড়িকা এক্সপ্রেস ও উদয়ন এক্সপ্রেস। টাঙ্গুয়ার এক্সপ্রেস নামে আরও একটি ট্রেন ঢাকা-সিলেট রেলপথে চলাচলের চূড়ান্ত কথা ছিল। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে এ ট্রেনটি চলাচল শুরু করেনি।
ওই সূত্রটি জানায়, ঢাকাগামী আন্তঃনগর কালনী এক্সপ্রেস শ্রীমঙ্গল স্টেশন থেকে সকাল ৮টা ২০ মিনিটে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যায়। এ ট্রেনে শ্রীমঙ্গল থেকে ঢাকা পর্যন্ত বরাদ্দকৃত আসন সংখ্যা মাত্র ৮১টি। এর মধ্যে শোভন চেয়ার ৬০টি, স্নিগ্ধা ১৫টি ও এসি সিট ৬টি। আন্তঃনগর জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস ট্রেন দুপুর ২টা ৪৫ মিনিটে শ্রীমঙ্গল থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যায়। এ ট্রেনে শ্রীমঙ্গল থেকে ঢাকা পর্যন্ত বরাদ্দকৃত আসন সংখ্যা মাত্র ৭০টি। এর মধ্যে শোভন চেয়ার ৫০টি, স্নিগ্ধা ২০টি। আন্তঃনগর পারাবত এক্সপ্রেস ট্রেন শ্রীমঙ্গল স্টেশন থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যায় বিকাল ৫টা ৪১ মিনিটে। এ ট্রেনে শ্রীমঙ্গল থেকে ঢাকা পর্যন্ত বরাদ্দকৃত টিকিট ১০৫টি। এর মধ্যে শোভন চেয়ার ৬০টি, স্নিগ্ধা ৩০টি ও এসি সিট ১৫টি। আন্তঃনগর উপবন এক্সপ্রেস ট্রেন মাধ্যরাত ১টা ৪৪ মিনিটে শ্রীমঙ্গল স্টেশন থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যায়। এ ট্রেনে শ্রীমঙ্গল থেকে ঢাকা পর্যন্ত টিকিট বরাদ্দ ৬৫টি। এর মধ্যে শোভন চেয়ার ৫০টি ও স্নিগ্ধা ১৫টি। চট্টগ্রামগামী আন্তঃনগর পাহাড়িকা এক্সপ্রেস ট্রেন শ্রীমঙ্গল থেকে দুপুর ১টা ২ মিনিটে চট্টগ্রামের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। এ ট্রেনে শ্রীমঙ্গল থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত টিকিট বরাদ্দ ৪৭টি। এরমধ্যে শোভন চেয়ার ৪০টি, স্নিগ্ধা ৪টি ও এসি সিট ৩টি এবং আন্তঃনগর উদয়ন এক্সপ্রেস ট্রেন রাত ১২টা ১৩ মিনিটে চট্টগ্রামের উদ্দেশে শ্রীমঙ্গল স্টেশন ছেড়ে যায়। এ ট্রেনে চট্টগ্রাম পর্যন্ত টিকিট বরাদ্দ শোভন চেয়ার ৩০টি। এসব আন্তঃনগর ট্রেনের মধ্যে ঢাকাগামী কালনী এক্সপ্রেস শুক্রবার, জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস বৃহস্পতিবার, পারাবত এক্সপ্রেস মঙ্গলবার, উপবন এক্সপ্রেস সোমবার, চট্টগ্রামগামী পাহাড়িকা এক্সপ্রেস বুধবার এবং উদয়ন এক্সপ্রেস রবিবার সাপ্তাহিক বন্ধ থাকে।
ঢাকার সাভার থেকে থেকে সপরিবারে শ্রীমঙ্গল আসা পর্যটক ব্যবসায়ী ইমরান হোসেন বলেন, ‘আমরা বাসে ঢাকা থেকে শ্রীমঙ্গল এসেছি। সকাল ৯টার দিকে ঢাকা থেকে রওয়ানা হয়ে প্রচুর জ্যাম টেলে সন্ধ্যা ৭টার দিকে পৌছেছি। প্রায় ১০ ঘণ্টার বিরক্তিকর জার্নিতে ছোট মেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। অথচ ট্রেনে শ্রীমঙ্গল থেকে ঢাকা যাতায়াত করতে সময় লাগে সাড়ে চার ঘণ্টা থেকে পাঁচ ঘণ্টার মতো। তাই যাওয়ার সময় যথেষ্ট চেষ্টা করেছি ট্রেনে যাওয়ার। কিন্তু ট্রেনের কোনো টিকিট সংগ্রহ করতে পারিনি। ট্রেনের টিকিট স্বল্পতায় আমাদের আবারও অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাসে করে ঢাকা যেতে হচ্ছে।’
রংপুরের পর্যটক আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘আমার ট্রেন জার্নি খুবই পছন্দের। ট্রেন নিরাপদ ও আরামদায়ক। ট্রেনে রংপুর থেকে ঢাকা এসে ঢাকা থেকে আমরা চার বন্ধু ট্রেনে করে শ্রীমঙ্গল ভ্রমণে এসেছি। কিন্তু শ্রীমঙ্গল থেকে ফেরার পথে টিকিট পাইনি। তাই বাধ্য হয়ে বাসে যাব। যেহেতু শ্রীমঙ্গল পর্যটন নগরী তাই ট্রেনগুলোর জন্য পর্যাপ্ত টিকিটের ব্যবস্থা রাখা দরকার ছিল।’
শ্রীমঙ্গল শহরতলীর রাধানগরস্থ শান্তিবাড়ি ইকো কটেজের সত্ত্বাধিকারী তানভীরুল আরেফিন লিংকন বলেন, ‘এক সময় আমাদের উপজেলায় প্রতিদিনই প্রচুর পর্যটক আসতেন। কিন্তু ঢাকা-চট্টগ্রাম থেকে শ্রীমঙ্গলে আগত পর্যটকরা শ্রীমঙ্গল থেকে ফেরার পথে ট্রেনের টিকিট পান না। আর সড়কপথে যাতায়াত অনেক সময় সাপেক্ষ ও অনিরাপদ হওয়ায় অনেকেই বাস জার্নি করতে চান না। ফলে শ্রীমঙ্গলে পর্যটক দিন দিন কমছে। আমরা প্রতিদিন ভোরে ঢাকা থেকে শ্রীমঙ্গল ও সন্ধায় শ্রীমঙ্গল থেকে ঢাকা একটি পর্যটক ট্রেন চালু করার জোর দাবি জানাই। রেল কর্তৃপক্ষ এ ধরনের পদক্ষেপ নিলে মৌলভীবাজার জেলায় একদিকে বাড়বে পর্যটকদের সংখ্যা, অন্যদিকে রেলওয়ে বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হবে।’
মৌলভীবাজারের পর্যটন গাইড শ্যামল দেববর্মা বলেন, ‘শ্রীমঙ্গল থেকে ট্রেনের টিকিট পাওয়া মানে সোনার হরিণ পাওয়া। পর্যটকরা এখানে ভ্রমণে এসে ট্রেনের টিকিট না পেয়ে হতাশ হন।’
শ্রীমঙ্গল পর্যটন সেবা সংস্থার যুগ্ম আহ্বায়ক মো. সেলিম আহমেদ বলেন, ‘প্রতিদিন পরিবার-পরিজন নিয়ে শ্রীমঙ্গলে কয়েকশত পর্যটক আসেন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। পর্যটকদের অধিকাংশই পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করেন। ঢাকা ও চট্টগ্রামের সঙ্গে শ্রীমঙ্গলের রয়েছে চমৎকার রেল যোগাযোগ। কিন্তু শ্রীমঙ্গল থেকে রেল যাতায়াতের জন্য রয়েছে মাত্র কয়েকটি টিকিট। পর্যটকদের যাতায়াত সুগম করতে এবং আরও বেশি সংখ্যক পর্যটক শ্রীমঙ্গলে আসার জন্য উৎসাহ প্রদান করতে প্রতিটি ট্রেনের সঙ্গে একটি করে পর্যটকবাহী বগি যুক্ত করা যেতে পারে। এ বগিতে পর্যটকদের অগ্রিম রুম বুকিং দেখে টিকিট ইস্যু করা যেতে পারে। এতে পর্যটকদের ভোগান্তি লাগব হবে।’
শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে স্টেশনের স্টেশন মাস্টার মো. সাখাওয়াত হোসেন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘শ্রীমঙ্গল থেকে ঢাকা এবং শ্রীমঙ্গল থেকে চট্টগ্রাম রেলপথে বর্তমানে মোট ছয়টি আন্তঃনগর ট্রেন চলাচল করে। এসব ট্রেনে অ্যাপসের মাধ্যমে যে টিকিট বরাদ্দ রয়েছে তার তুলনায় অনেক বেশি চাহিদা। আমাদের পক্ষ থেকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে টিকিটের চাহিদার কথা অবহিত করা হয়েছে। এছাড়া টাঙ্গুয়ার এক্সপ্রেস নামে আরও একটি ট্রেন ঢাকা-সিলেট রেলপথে চলাচলের কথা ছিল। এখনো এটি চালু হয়নি। তবে দ্রুততম সময়ের মধ্যে এ ট্রেনটি অথবা অন্যকোন ট্রেন চালু হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। ওই ট্রেন চালু হলে ট্রেনের টিকিটে সংকট কিছুটা হলেও কাটবে।