Home » news » সময়ের স্রোতে হারিয়ে যাচ্ছেন ঘড়ির ডাক্তাররা
সময়ের সঙ্গে মানুষের জীবনযাত্রা বদলে যায়, আর সেই সঙ্গে বদলে যায় পেশাও। নতুন নতুন কাজের সুযোগ তৈরি হয়, আবার কিছু কিছু পেশা ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকে। যারা নতুন সময়ের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেন, তারা এগিয়ে যান। কিন্তু কেউ কেউ তাদের পুরোনো পেশার সঙ্গেই থেকে যান, কারণ সেই কাজই তাদের একমাত্র জীবন, ভালোবাসা আর নেশা।
পুরান ঢাকার অলিগলি যেন সেই পুরোনো সময়ের সাক্ষী। এখানে ছড়িয়ে আছে বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ছাপ। সেই পুরান ঢাকার একটি বিশেষ জায়গায়, সদরঘাটে, খুঁজে পাওয়া যায় সময়ের সঙ্গে লড়াই করা কিছু মানুষকে, যারা ঘড়ি মেরামতের কাজ করেন—আমরা তাদের বলি ‘ঘড়ির ডাক্তার’।
১৯৩৪ সালে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনপ্রিয় গোয়েন্দা চরিত্র ব্যোমকেশ বক্সীর গল্প “পথের কাঁটা” ‘তে একটি পকেট ঘড়ির উল্লেখ পাওয়া যায়। সেকালে পকেট ঘড়ি ছিল আভিজাত্যের প্রতীক। ২০ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত এই ঘড়ির জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে, বিশেষত বিয়েতে হাতঘড়ি উপহার দেওয়ার চল শুরু হলে এর কদর বাড়তে থাকে। নব্বইয়ের দশকেও ঘড়ি ছিল বেশ সাধারণ ব্যবহার্য জিনিস। সবাই ঘড়ি ব্যবহার করত, এবং বাড়ির দেওয়ালে বড় ঘড়ি থাকার রেওয়াজও ছিল।
কিন্তু প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ঘড়ির জনপ্রিয়তা কমতে শুরু করে। মুঠোফোনের আবির্ভাবে ঘড়ির ব্যবহার ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে চলে যায়। ঘড়ির সঙ্গে হারিয়ে যেতে শুরু করে সেই সব মানুষ, যারা ঘড়ি মেরামত করতেন। সদরঘাটের মোহাম্মদ সেলিম তাদেরই একজন।
মোহাম্মদ সেলিম ১৯৮৪ সালে ঘড়ি সারাইয়ের কাজ শেখেন। পরিবারের আর্থিক অনটনের জন্য পড়াশোনা চালাতে না পারলেও, ঘড়ি মেরামতের কাজ তাকে টেনে নেয় জীবনের পথে। আশির দশকে ঘড়ির চাহিদা ছিল অনেক বেশি, আর সেই সময় ঘড়ির ডাক্তারদেরও খুব কদর ছিল। ঘড়ি মালিকরা ঘড়ির প্রতি ছিল বেশ যত্নশীল, ফলে সেটি যত পুরোনোই হোক না কেন, সারাইয়ের জন্য নিয়ে আসতেন ঘড়ির ডাক্তারের কাছে। সেলিমের জন্য সেই সময়টা ছিল রমরমা ব্যবসার যুগ।
একবার এক নৌবাহিনীর কর্মকর্তা সোনার ঘড়ি মেরামতের জন্য সেলিমের কাছে নিয়ে আসেন। ঘড়িটা দেখে সেলিম এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, সেটি কেনার জন্য নিজের সর্বস্ব দিয়ে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ঘড়ির মালিক রাজি হননি। সেই ঘড়ি তার কাছে রয়ে গেল স্মৃতির এক বিশেষ অধ্যায় হিসেবে।
আজকের দিনে মোহাম্মদ সেলিমের ঘড়ির দোকানটি অনেক মলিন আর জরাজীর্ণ। পুরোনো দিনের সেই জৌলুস নেই, তবে সেলিম এখনও প্রতিদিন ১৫-২০টি ঘড়ি মেরামতের কাজ করেন। স্থানীয় মানুষের ঘড়ি সারানোর জন্য দোকানে আসা এখন অনেকটাই কমে গেছে, তবে কিছু বয়স্ক মানুষ এখনও পুরোনো ঘড়ির ব্যবহার চালিয়ে যাচ্ছেন। মোবাইল ফোনের যুগে ঘড়ির ডাক্তারদের চাহিদা কমে গেছে, কিন্তু সেলিমের মতো মানুষদের জন্য এটি শুধু পেশা নয়, এটি তাদের জীবনের একটি অংশ।
সেলিম ছাড়াও সদরঘাটের আরও অনেক ঘড়ির ডাক্তার ছিলেন, যেমন মতিউর রহমান মতিন। তিনি চার দশক ধরে ঘড়ি মেরামতের কাজ করে গেছেন। এখন বয়সের ভারে আর কাজ করতে পারেন না, তবে স্থানীয়দের কাছে তিনি এখনও পরিচিত ‘মতিন চাচা’ নামে। সময়ের সঙ্গে তাদের পেশা বিলুপ্ত হয়ে গেছে, কিন্তু তাদের স্মৃতির ছাপ থেকে গেছে।
মোবাইল আর স্মার্টওয়াচের যুগে ঘড়ির ডাক্তাররা আজ প্রায় হারিয়ে গেছেন। তাদের দিনগুলো কাটে অসহায়ভাবে, অনেকেই পেশা বদলাতে বাধ্য হয়েছেন। সময়ের ধর্মই বটে, সে থেমে থাকে না, আর ঘড়ির ডাক্তাররাও ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছেন।