সেপ্টেম্বরে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে জাতিসংঘে বিশেষ অধিবেশন

রুশাইদ আহমেদ: অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আগামী সেপ্টেম্বরে বিশেষ অধিবেশন বসবে জাতিসংঘে। ফিনল্যান্ড ও অস্ট্রিয়া এই বিশেষ অধিবেশন আয়োজন করবে বলে আশ্বাস দিয়েছে। সংস্থাটির মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বাংলাদেশ সফর শেষে প্রধান উপদেষ্টাকে এ কথা জানান।

মঙ্গলবার (২৫ মার্চ) সন্ধ্যা ৭টায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বিষয়টি উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা।

আসিয়ানে যোগ দিতে আবেদন

ভাষণে ড. ইউনূস বলেন, বিশ্বপরিমণ্ডলে বাংলাদেশের অবস্থান দৃঢ় করতে আমরা দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশসমূহের আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা আসিয়ানে যোগদানের আবেদন করেছি। বর্তমানে মালয়েশিয়া সংস্থাটির সভাপতির দায়িত্বে রয়েছে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম ইতিমধ্যে আমাদের যোগদানের আবেদনকে সমর্থন করেছেন। এ সময়, মালয়েশিয়া সফরে দেশটির প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণ গ্রহণ করার কথাও জানান প্রধান উপদেষ্টা।

চীন সফর নিয়ে যা বললে প্রধান উপদেষ্টা

আসন্ন চীন সফর নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যকার কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতামূলক সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নিতে আমি চীন সফরে যাচ্ছি। সেখানে দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করার কথা জানান তিনি। চীন বাংলাদেশ থেকে আম, কাঁঠাল ও পেয়ারা আমদানি করতে ইচ্ছুক বলেও উল্লেখ করেন নোবেলজয়ী এই অর্থনীতিবিদ। একইসঙ্গে নেপাল, ভুটান এবং ভারতের সেভেন সিস্টার্সে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানির বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ার কথাও জানান ড. ইউনূস।

এ সময়, দেশের প্রযুক্তি ও স্বাস্থ্য খাতে চীনের বিনিয়োগ করার প্রসঙ্গে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন ড. ইউনূস। এ ছাড়া, দেশটির সর্ববৃহৎ সৌর প্যানেল নির্মাতা প্রতিষ্ঠান লংগির শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গেও বৈঠক করবেন তিনি।

নেপাল থেকে আমদানি করা হবে জলবিদ্যুৎ

অনবায়নযোগ্য জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমাতে নেপাল থেকে জলবিদ্যুৎ আমদানি করা হবে বলে ভাষণে উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা।

তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারী বর্তমানে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমাতে জোর দিচ্ছেন। এরই অংশ হিসেবে আমরা নেপাল থেকে সাশ্রয়ী মূল্যে জলবিদ্যুৎ আমদানি করব। ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করা আরও সহজ হবে। এ প্রসঙ্গে রুশ পাওয়ার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রোসাটমের মহাপরিচালক সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছেন বলেও জানান তিনি।

আরব আমিরাতের সঙ্গে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক বৃদ্ধি

আরব আমিরাতও বাংলাদেশে নতুন শিল্পাঞ্চল গড়ে তুলতে কাজ করবে উল্লেখ করেন ড. ইউনূস। তিনি বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশ আরব আমিরাতও বাংলাদেশে শিল্পাঞ্চল গড়ে তুলতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। আমরা ইতিমধ্যে তাদের দেশে হালাল মাংস ও মাছ প্রক্রিয়াকরণ কারখানা স্থাপনের প্রস্তাব দিয়েছি। এ ছাড়া, নদীবন্দরগুলো পরিচালনায়ও দেশটির সহযোগিতা চাওয়ার কথা জানান তিনি।

দুর্নীতি মোকাবেলায় সরকারের পদক্ষেপ

দুর্নীতিকে দেশের অগ্রগতির বড় অন্তরায় উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন:

সীমাহীন দুর্নীতি আমাদের দেশের জন্য বড় সমস্যা। বিগত সরকারের আমল থেকে দুর্নীতির কারণে দেশের সামষ্টিক ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়-দায়িত্ব প্রতিপালন অর্থহীন হয়ে পড়ছে। সরকার, ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী থেকে শুরু করে সাধারণ নাগরিকেরা এই দুর্নীতির জালে অলিখিতভাবে ঢুকে পড়ছেন।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশকে দুর্নীতিমুক্ত হতে দেখতে চায় উল্লেখ করে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় চায় প্রতিটা ক্ষেত্রে আমরা যেন দুর্নীতিমুক্ত হই। এ লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকার দুর্নীতি ও নাগরিক হয়রানি রোধে কাজ করছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা ইতিমধ্যে সরকারি অফিসে ই-ফাইলিং সিস্টেম চালু করেছি। ফলে সশরীরে কোনো সেবাগ্রহীতাকে আর সরকারি অফিসগুলোতে যেতে হবে না। অনলাইনে জিডি করা, ভূমিসেবা ডিজিটালাইজ করার মতো পদক্ষেপ নেওয়ায় দুর্নীতি কমার পাশাপাশি দেশের নাগরিকদের হয়রানি কমবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। এ সময়, পুলিশ ভেরিফিকেশনের জটিলতাজনিত কারণে আটকে থাকা ৭০ হাজার পাসপোর্ট সেবাগ্রহীতারা হাতে পেয়েছেন বলে জানান তিনি।

৬২৯৫টি মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার

বিগত সরকারের আমলে মিথ্যা মামলা দায়েরের মাধ্যমে হয়রানির ইস্যু নিয়েও কথা বলেন ড. ইউনূস। তিনি বলেন, বওগত ফ্যাসিস্ট সরকার মিথ্যা মামলা দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এবং ভিন্ন মতাদর্শের ব্যক্তিদের নিরবিচ্ছিন্ন হয়রানি করেছে। তাদের সেই হয়রানি লাঘবে অন্তর্বর্তী সরকার ৬২৯৫টি মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ ছাড়া, সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টের আওতায় দায়েরকৃত ৪১৩টি মামলা প্রত্যাহারের বিষয়েও সরকার বিবেচনা করছে বলে জানান তিনি।

সংস্কার কার্যক্রম নিয়ে

সংস্কার কার্যক্রম নিয়ে ড. ইউনূস বলেন, দেশের বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে সংস্কার আনয়নের লক্ষ্যে গঠিত কমিশনগুলো এরই মধ্যে ১৬৬টি সংস্কার পদক্ষেপ গ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছে। সে অনুযায়ী অন্তর্বর্তী সরকার কাজ করছে।

সংবিধান, সরকারব্যবস্থা এবং প্রশাসন সংশ্লিষ্ট সংস্কারের বিষয়ে ৩৮টি রাজনৈতিক দল মত দিয়েছে উল্লেজ করে তিনি আরও বলেন, দেশের ৩৮টি রাজনৈতিক দল সংবিধান ও সরকারব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে মত দিয়েছে। সংস্কার কার্যক্রম সুচারুরূপে সম্পন্নার্থে যে যে ইস্যুতে দলগুলোর প্রতিনিধিবৃন্দ একমত হবে সেগুলোর তালিকা করে একসঙ্গে জুলাই চার্টার বা জুলাই সনদ প্রণয়ন করা হবে বলে জানান তিনি।

এ সময়, সংস্কার কার্যক্রম শেষে চলতি বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনে সরকার ও নির্বাচন কমিশন কাজ করছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

এ ছাড়া, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া থেকে বন্ধে অন্তর্বর্তী সরকার রাজস্ব সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব মোতাবেক বিদ্যমান জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ভেঙে নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরির কথা ভাবছে বলেও উল্লেখ করেন ড. ইউনূস।

তিন মাসের মধ্যে স্টারলিংকের সংযোগ স্থাপনে চুক্তি

বাংলাদেশে স্টারলিংকের সংযোগ স্থাপন সম্পর্কে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, স্টারলিংকের প্রধান নির্বাহী ইলন মাস্কের সঙ্গে বাংলাদেশে ইন্টারনেট পরিষেবা সংযোগ স্থাপন সংক্রান্ত আলাপের সূত্র ধরে প্রতিষ্ঠানটির প্রতিনিধিরা ইতিমধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছেন। তিন মাসের মধ্যেই এ বিষয়ে বাণিজ্যচুক্তি করা হবে। এর মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসরত নাগরিকেরাও স্বল্প মূল্যে উচ্চগতির ইন্টারনেট পরিষেবা ব্যবহারের সুযোগ পাবেন বলে প্রত্যাশা করেন তিনি।

বাংলাদেশি হাজীদের জন্য চালু করা হবে বিশেষ অ্যাপ

পবিত্র হজ পালনে গিয়ে বাংলাদেশি হাজীদের বিড়ম্বনা রোধে বিশেষ অ্যাপ চালুর কথা উল্লেখ করেন ড. ইউনূস।

তিনি বলেন, পবিত্র হজে গিয়ে হাজীরা অনেকসময় স্বাস্থ্যঝুঁকি, লজিস্টিকসহ নান ধরনের ঝামেলায় পড়েন। এসব সমস্যা লাঘবে আমরা বিশেষ মোবাইল অ্যাপ চালু করেছি বাংলা ভাষায়। অ্যাপটি ব্যবহার করে হাজীরা লাগেজ ট্র্যাকিং, প্রতিদিনের করণীয়, বিশেষ দোয়া পড়া থেকে শুরু করে পবিত্র স্থানের ভ্রমণের তথ্য এবং অসুস্থ হলে চিকিৎসকের সঙ্গে হটলাইনে যোগাযোগ করার মতো সুবিধা পাবেন।

গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় গুজবের মহোৎসব

অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সংস্কার কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করতে গুজবের মহোৎসব চলছে উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন:

অন্তর্বর্তী সরকার কাজ শুরুর পর থেকেই নানা গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় গুজবের মহোৎসব চলছে। এক ছবির সঙ্গে অন্য ছবি কিংবা অন্য দেশের ঘটনাকে বাংলাদেশের ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করে ফটোকার্ড বানিয়ে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। সীমাহীন অর্থ ঢালা৷ হচ্ছে এর পেছনে। এগুলো কারা করছে, আপনারা জানেন। নির্বাচন এগিয়ে এলে এটা আরও বাড়বে। এ সময়, দেশবাসীকে একত্রে ‘জুলাইবিরোধী পলাতক অপশক্তির ষড়যন্ত্রের অংশ এই গুজবকে’ মোকাবেলা করার আহ্বান জানান তিনি।

 মানবাধিকার হাইকমিশনের রিপোর্ট প্রসঙ্গে

জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দমনে বিগত সরকারের পদক্ষেপের ওপর প্রকাশিত জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনের রিপোর্ট নিয়েও কথা বলেন ড. ইউনূস। তিনি বলেন, শেখ হাসিনার সরাসরি নির্দেশেই যে জুলাই-আগস্টে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে তা ইতিমধ্যে মানবাধিকার হাইকমিশনের রিপোর্টে প্রকাশিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের সকলে মিলে এই মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড করেছে। শুধু তাই নয়, হত্যার পর তারা মানুষ লুকাতে পুড়িয়েও ফেলেছে। মিছিলে সম্মুখসারিতে থাকা আমাদের মেয়েদের হয়রানি ও যৌন নির্যাতন করেছে। গোটা বিশ্বে এসব অপরাধের জন্য স্বীকৃত অপরাধীদের বিচার দেশের মাটিতে হবে বলেও দেশবাসীকে আশ্বস্ত করেন তিনি।

নতুন বাংলাদেশ গঠনে নারীদের অংশগ্রহণ

নতুন বাংলাদেশ গঠনে নারীদের অংশগ্রহণের প্রতিও জোর দেন ড. ইউনূস। তিনি বলেন, স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও নারীরা বৈষম্যের শিকার হবেন এটা মেনে নেওয়া যায় না। অতীতের সকল আন্দোলন-সংগ্রামের চেয়ে জুলাই অভ্যুত্থানে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল সবচেয়ে বেশি৷ তাই নারীদের নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে এবং পুরুষদের সমান অগ্রাধিকার দিতে হবে।

দেশবাসীকে ছেলে এবং মেয়ে শিশুর মধ্যে পার্থক্য করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়ে তিনি আরও বলেন, নিজ নিজ অবস্থান থেকে ছেলে-মেয়ে সকলকে সমান চোখে দেখতে হবে। নারীদের খাটো করে দেখা বা অসম্মান করার বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। নারীদের সুরক্ষায় অন্তর্বর্তী সরকার কাজ করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, নারীদের সুরক্ষায় আমরা কাজ করছি। এ লক্ষ্যে পুলিশের বিশেষ হটলাইন নম্বর চালু করা হয়েছে। পাশাপাশি, নারী ও শিশু নির্যাতন আইনও সংশোধন করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

ভাষণের শেষে দেশবাসীকে স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা জানান প্রধান উপদেষ্টা।