মোহাম্মদ নিলয়, স্টাফ রিপোর্টারঃ
সেলেব্রিটি ক্রিকেট লীগের নাম শুনলেই অনেকের মনে ভেসে ওঠে খেলার আনন্দ, তারকাদের বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিযোগিতা আর বিনোদনের মিশেল। কিন্তু বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে সেলেব্রিটি ক্রিকেট লীগ। যেখানে অংশ নিয়েছেন দেশের শোবিজ অঙ্গনের জনপ্রিয় সকল তারকা। ছিলেন ছোট পর্দা থেকে শুরু করে বড় পর্দার সকল অভিনেত্রীরাও। ছেলে-মেয়েদের মিশলে এই ক্রিকেট লীগ মাঠের বাইরে জন্ম দিয়েছে ভিন্ন এক গল্পের।
যেখানে দেখা গিয়েছে খেলাধুলার চেয়ে বেশি জায়গা দখল করে নিয়েছে অশ্লীলতা, বেহায়াপনা আর ইউটিউব রিলস বানানোর প্রতিযোগিতা। মাঠে খেলোয়াড়দের চেয়ে ক্যামেরার উপস্থিতি বেশি, খেলার চেয়ে দৃষ্টি কাড়ে কে কেমন পোশাকে এসেছে, কে কেমন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়েছে, আর কার ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হচ্ছে। একদিকে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা মাঠে ঢুকে পড়ছে অদ্ভুত সাজে, যেন র্যাম্প শোতে অংশ নিতে এসেছে, অন্যদিকে খেলার নিয়ম-নীতি ও কৌশল প্রায় অনুপস্থিত। পুরুষ খেলোয়াড়রা জার্সি খুলে শরীর দেখাচ্ছেন, নারীরা এমন পোশাক পরছেন যা খেলার মাঠের জন্য একেবারেই অনুপযুক্ত সবকিছু মিলিয়ে পুরো পরিবেশ হয়ে উঠছে একটা অদ্ভুত বিনোদন অনুষ্ঠান, যেখানে খেলার গন্ধটুকুও নেই। আর এইসব কনটেন্ট আবার বিভিন্ন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে এমনভাবে ছড়ানো হচ্ছে, যেন দেশের তরুণ প্রজন্মকে জানাতে হবে বিনোদনের মানে এখন আর অভিনয় বা প্রতিভা নয়, বরং শরীর প্রদর্শনই এখনকার মূল পণ্য।
আয়োজকরা নিজেদের বলছেন ‘বিনোদন উদ্যোক্তা’, কিন্তু তারা যা করছেন তা আসলে ব্যবসা, ভিউয়ের ব্যবসা, ভাইরাল হওয়ার ব্যবসা, আর তারকাদের জনপ্রিয়তাকে নগ্নভাবে বাজারে তোলা। তাছাড়া কিছু কিছু গণমাধ্যমও এই সব আয়োজনকে গ্ল্যামারাইজ করে আরও বেশি প্রচার করছে, এমনকি এমন সব হেডলাইন দিচ্ছে যা দেখে মনে হয় খেলোয়াড়রা নয়, ফ্যাশন আইকনরা মাঠে নেমেছেন। খেলায় কে কত রান করলো, কে ভালো বল করলো সেটা গুরুত্ব পাচ্ছে না। গুরুত্ব পাচ্ছে কে কতটা আবেদনময়ী পোশাকে এসেছে কিংবা কে ক্যামেরার সামনে কতটা ‘এক্সপ্রেসিভ’। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় হলো, এই সমস্ত ভিডিও এখন ভাইরাল হচ্ছে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া কিশোর-কিশোরীদের মাঝেও। তারা এইসব দেখে ভাবছে, এটাই হয়তো তারকা হওয়ার শর্টকাট পথ।
অভিনয় বা দক্ষতা নয়, ক্যামেরার সামনে নিজেকে বিকিয়ে দিলেই হয় জনপ্রিয়তা। এই ভুল বার্তা তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে পারে। কারণ, তারা যদি বুঝতেই না পারে যে খেলাধুলা বা অভিনয়ের প্রকৃত মূল্য কোথায়, তাহলে ভবিষ্যতে তারা কোন পথে হাঁটবে? এটা কি আমাদের সংস্কৃতি? এটা কি আমাদের মিডিয়া? এসব প্রশ্ন এখন আমাদের সামনে তীব্রভাবে উপস্থিত। অথচ এইসব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করছে না। যারা কথা বলবে, তারা হয়তো স্পন্সরের ভয় পাচ্ছে, বা তারকাদের রাগান্বিত না করার চেষ্টা করছে। প্রশাসন, স্পোর্টস বোর্ড বা বিনোদন জগতের প্রভাবশালীরা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে।
এর নামই হলো নির্লজ্জ সম্মতি যেখানে সবকিছু চোখের সামনে হচ্ছে, তবু সবাই চুপ। অথচ আমরা জানি, খেলাধুলা মানে প্রতিযোগিতা, সম্মান, শৃঙ্খলা আর কৌশলের লড়াই। অভিনয় মানে দর্শককে ছুঁয়ে যাওয়া, সমাজে পরিবর্তন আনা। কিন্তু আজকের সেলেব্রিটি ক্রিকেট লীগ এসব কিছুকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে এক ধরনের অপ্রয়োজনীয় ও বিকৃত বিনোদনের জন্ম দিচ্ছে, যা আমাদের সংস্কৃতি, তরুণ সমাজ ও খেলাধুলার ভবিষ্যতের জন্য চরম হুমকি। তাই সময় এসেছে প্রশ্ন তোলার, সময় এসেছে এইসব আয়োজনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর। কারণ, সেলেব্রিটি ক্রিকেট লীগের নামে এই যে অশ্লীলতা ও কৃত্রিমতার মেলা বসছে, তা আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতিকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। এবং যদি এখনই আমরা এই সব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সরব না হই, তবে সামনে হয়তো আর কোনো সত্যিকারের প্রতিভাবান খেলোয়াড় মাঠে নামবে না, কোনো শিশু আর ক্রিকেটকে ভালোবাসবে না, এবং মিডিয়ায় জায়গা পাবে শুধুই ‘কনটেন্ট’ তৈরি করা মুখগুলো, যারা খেলার নামে অশ্লীলতা বিক্রি করে ভাইরাল হতে চায়।