শৈশবে আমাদের শেখানো হয়, “লেখাপড়া করে যে, গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে,” যা শিক্ষার উদ্দেশ্যকে শুধুমাত্র আর্থিক সফলতার দিকে সীমাবদ্ধ করে। এটি শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য থেকে আমাদের দূরে সরিয়ে দেয়। শিক্ষার উদ্দেশ্য শুধুমাত্র অর্থনৈতিক উন্নতি নাকি ব্যক্তিগত, নৈতিক এবং সামাজিক দায়িত্ববোধ তৈরির প্রয়োজন? এই প্রশ্নটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে, যেখানে শিক্ষাকে প্রায়ই কেবলমাত্র অর্থনৈতিক সুযোগ হিসেবে দেখা হয়।
শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য: আর্থিক সাফল্য বনাম সামাজিক দায়িত্ব
শিক্ষার উদ্দেশ্য শুধুমাত্র অর্থ উপার্জনের সুযোগ নয়। পিউ রিসার্চ সেন্টারের একটি জরিপে দেখা গেছে যে ৪৭% মানুষ বিশ্বাস করে যে শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য কর্মজীবনের জন্য দক্ষতা অর্জন করা। অন্যদিকে, ৩৯% মানুষ মনে করে শিক্ষার লক্ষ্য হওয়া উচিত ব্যক্তিগত ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ (Pew Research Center). শিক্ষার এই বহুমাত্রিকতা কেবলমাত্র পেশাগত জীবনের জন্য নয়, ব্যক্তিগত এবং সামাজিক জীবনের জন্যও প্রয়োজন।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শিক্ষাকে অধিকাংশ সময় শুধুমাত্র চাকরি বা আর্থিক স্থিতির জন্য দেখা হয়। বাংলাদেশের তরুণ সমাজের মধ্যে একটি সাধারণ প্রবণতা দেখা যায় যেখানে শিক্ষার্থীরা উচ্চতর বেতনের চাকরি পাওয়ার আশায় লেখাপড়ায় মনোযোগ দেয়, কিন্তু সামাজিক এবং নৈতিক দায়িত্ববোধের প্রতি তাদের মনোযোগ অনেক কম। জাতীয় শিক্ষা জরিপ ২০১৯ অনুযায়ী, বাংলাদেশে শিক্ষার হার বেড়েছে, তবে এর মান এখনো উন্নত দেশের তুলনায় অনেক পিছিয়ে আছে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশে মাধ্যমিক স্তরে গড় শিক্ষার্থীর অর্জন শুধুমাত্র ৩৫-৪০%। তবে, দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে সাথে চাকরির প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং শিক্ষার্থীরা তাদের পড়াশোনাকে শুধুমাত্র কর্মজীবন এবং বেতন-ভিত্তিক সফলতার দিকে সীমাবদ্ধ রাখছে (Pew Research Center)।
উন্নত দেশের তুলনায় শিক্ষার মান
উন্নত দেশের শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার উদ্দেশ্যকে আরও ব্যাপকভাবে বিবেচনা করে। উদাহরণস্বরূপ, ফিনল্যান্ড এবং ডেনমার্ক এর মতো দেশগুলোতে শিক্ষার মূল লক্ষ্য হল ব্যক্তিগত বিকাশ, নৈতিক শিক্ষা, এবং সামাজিক দায়িত্ব। ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের কেবলমাত্র কর্মসংস্থানের দিকে নয়, বরং সামাজিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের উপরও গুরুত্ব দেওয়া হয়। এ ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা সমাজে কম দুর্নীতি এবং একটি স্থিতিশীল নৈতিক কাঠামো গড়ে তুলতে সাহায্য করে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল এর একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, ফিনল্যান্ড এবং ডেনমার্ক বিশ্বের সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম, যেখানে শিক্ষার মাধ্যমে নৈতিক এবং সামাজিক মূল্যবোধের চর্চা করা হয় (Pew Research Center).
দুর্নীতি এবং শিক্ষার ভুল দৃষ্টিভঙ্গি
বাংলাদেশে শিক্ষার ভুল দৃষ্টিভঙ্গি প্রায়শই দুর্নীতির দিকে পরিচালিত করে। যখন শিক্ষার উদ্দেশ্য শুধুমাত্র অর্থ উপার্জন এবং ধনসম্পত্তি অর্জনের জন্য সীমাবদ্ধ থাকে, তখন শিক্ষার্থীরা দ্রুত ধনী হওয়ার জন্য অনৈতিক উপায় অবলম্বন করতে শুরু করে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ২০২১ সালের দুর্নীতি সূচক অনুযায়ী, বাংলাদেশ দুর্নীতির দিক থেকে ১৪৬ তম অবস্থানে রয়েছে। এর প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে সামাজিক এবং নৈতিক শিক্ষার অভাব। যদি শিক্ষার্থীদের নৈতিক শিক্ষা এবং সামাজিক দায়িত্ববোধ শেখানো হয়, তাহলে দুর্নীতির মাত্রা হ্রাস পাবে(Investopedia)।
শিক্ষার উদ্দেশ্য পরিবর্তন: নৈতিকতা ও সামাজিক দায়িত্বের গুরুত্ব
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা শুধুমাত্র আর্থিক সাফল্যের দিকে না তাকিয়ে নৈতিকতা, মূল্যবোধ, এবং সামাজিক দায়িত্বের দিকে মনোযোগ দিলে দেশে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে। শিক্ষার্থীদের শুধুমাত্র চাকরি বা বেতনের প্রতি না ঠেলে দিয়ে, তাদের নৈতিক এবং সামাজিক মূল্যবোধ শেখানো হলে ভবিষ্যতে সমাজে দুর্নীতির হার অনেকাংশে কমে যাবে। উন্নত দেশের শিক্ষাব্যবস্থা অনুসরণ করে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার মৌলিক সংস্কার করলে, সমাজে নৈতিক ও সামাজিক উন্নতি দেখা যাবে।
উপসংহার
“লেখাপড়া করে যে, গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে” এর পরিবর্তে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় শেখানো উচিত “লেখাপড়া করে যে, মানুষের মতো মানুষ হয় সে।” শিক্ষার উদ্দেশ্য কেবলমাত্র আর্থিক সফলতা নয়; এটি একজন নৈতিক, দায়িত্ববান, এবং মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ গড়ে তোলার প্রক্রিয়া। উন্নত দেশের উদাহরণ অনুসরণ করে যদি বাংলাদেশও শিক্ষার মান এবং উদ্দেশ্য পরিবর্তন করতে পারে, তাহলে আমরা একটি নৈতিক এবং দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়তে সক্ষম হবো, যেখানে শিক্ষার্থীরা কেবল ধনসম্পত্তি অর্জনের জন্য নয়, বরং সমাজের উন্নয়নে অবদান রাখতে শিখবে।
লেখক:
মোঃ আব্দুস সবুর
লেকচারার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়