২৪শে’র গণঅভ্যুত্থানের সূচনা সরকারি চাকুরিতে কোটা বৈষম্য নিয়ে। ধীরে ধীরে কোটা আন্দোলন রুপ নেয় ১৬ বছরের আওয়ামী স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে। ফলস্বরূপ ক্ষমতা ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয় শেখ হাসিনা। স্বৈরাচার পতনের এ আন্দোলনের ‘আঁতুরঘর’ দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সরকারের মদদে ছাত্রলীগের চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, সিট বানিজ্য, ও র্যাগিংসহ বেপরোয়া সব কর্মকান্ডের ফলে জমে থাকা ক্ষোভই গণঅভ্যূত্থানে রুপ দেয় জুলাইয়ের আন্দোলনকে। তবে গণঅভ্যূত্থানের আগে ছাত্রলীগের নিপীড়নের বিরুদ্ধে দ্বিধাহীনভাবে লড়ে প্রতিবাদের সাহসী উদাহরণ হয়েছেন ইবি শিক্ষার্থী ফুলপরী।
আওয়ামী সরকারের আমলে তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নির্মমতার বলি হয়ে বেশির ভাগই মুখ বুজে সহ্য করতেন। কিন্তু চিরাচরিত প্রথা ভেঙে প্রতিবাদের পথ বেছে নিয়েছিলেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) ফ্রিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের ফুলপরী। ২০২৩ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারী রাত ১১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শেখ হাসিনা হলের গণরুমে দফায় দফায় নির্যাতন করা হয় সদ্য ক্যাম্পাসে আসা ফুলপরীকে। তৎকালীন শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সানজিদা চৌধুরী অন্তরার নেতৃত্বে সংগঠনটির ৭/৮ জন কর্মী মিলে এ অমানবিক নির্যাতন চালায়। এলোপাতাড়ি চড়-থাপ্পড়, মুখ চেপে ধরে গালিগালাজ করা এমনকি ময়লা গ্লাস মুখ দিয়ে পরিষ্কার কারানো হয়েছিলো তাকে দিয়ে। এক পর্যায়ে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ ও তা সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে ভাইরাল করার হুমকি দেয় ছাত্রলীগ নেত্রীরা এবং এ ঘটনা কাউকে জানালে হত্যার হুমকিও দেওয়া হয়েছিলো তাকে।
ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্রলীগ ছিল বেপরোয়া। যাদের কাছে জিম্মি ছিলো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে শুরু করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। ফ্যাসিজমের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছানো সংগঠনটির অন্যায় সবাই যখন মুখ বুজে সহ্য করেছিলো, তখন নবীন শিক্ষার্থী ফুলপরী হেঁটেছে বিপরীত পথে। মৃত্যুর ভয় উপেক্ষা করে লড়ে যায় নিজের সাথে ঘটে যাওয়া নৃশংসতার বিরুদ্ধে। তার এই একক প্রতিবাদ দ্রুত ছড়িয়ে পরে দেশে। প্রতিবাদী হয়ে ওঠে এতোদিন ধরে মুখ বুঝে সহ্য করা শিক্ষার্থীরা। তীব্র প্রতিবাদ ও সমালোচনার মুখে অভিযুক্তদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থায়ী বহিষ্কার করা হয়। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ফুলপরীর মতো এমন প্রতিবাদগুলো স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে সাহস জুগিয়েছিলো শিক্ষার্থীদের।
ফুলপরীর এই প্রতিবাদ নিয়ে তিনি বলেন, আমি যেটা করেছিলাম, সেটা আমার কর্তব্য মনে করেই করেছিলাম। বিনা অপরাধে আমার সাথে অন্যায় হয়েছিলো। তাই কোনো অন্যায়, অবিচারও আমি মুখ বুজে সহ্য করার কথা ভাবি নাই। অপরাধীকে ভয় পেলে তাদের অপরাধের মাত্রা বেড়ে যায়। তাই তাদের ভয় না পেয়ে প্রতিহত করতে হবে। আমি তখন ক্যাম্পাসে নতুন ছিলাম তাই হয়তো তারা আমাকে দূর্বল ভেবে তাদের শক্তিমত্তা জাহির করতে চেয়েছিলো। সবশেষে কথা হলো অপরাধ করা ও অপরাধ মুখ বুজে সহ্য করা সমান। তাই অপরাধী যত বড় হোক তা মেনে নেওয়ার কোন মানে হয় না।
জুলাইয়ের আন্দোলন স্মরণ করে ফুলপরী জানান, আন্দোলনের সময় নিজ জেলা পাবনাতে ছিলেন তিনি। গত ৪ আগষ্ট আওয়ামী সরকার পতনের আগের দিন ছিলো সবচেয়ে বিভৎস। সেদিন আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হামলায় পাবনায় একাধিক মানুষ শহীদ হয়। যা দেখার পরেও আন্দোলন চলমান রাখেন তিনি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সকল বর্ণের মানুষের রাজপথে একত্রে প্রতিবাদই দেশ থেকে স্বেরাচার বিতাড়িত করতে সক্ষম হয়েছে বলে মনে করেন ফুলপরী।
গণঅভ্যূত্থান পরবর্তী নতুন বাংলাদেশ নিয়ে ফুলপরী বলেন, ২৪শে’র আন্দোলন ছিলো সকল প্রকার বৈষম্যের বিরুদ্ধে। সকল প্রকার অন্যায়, বৈষম্য যখন দেশ থেকে নিপাত যাবে তখনই আন্দোলনের শহীদের রক্তের যথাযথ মূল্যায়ন করা হবে। আমরা চাই এমন এক রাষ্ট্র যেখানে সাম্য থাকবে, ন্যায়বিচার থাকবে। অপরাধ কারার আগে মানুষ আইন কে ভয় পেয়ে আপরাধ থেকে দূরে থাকবে। যেখানে নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ সবাই নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের কাছে সমান মর্যাদা পাবে। আমাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গবেষণা খাত ঢেলে সাজাতে হবে। আমি চাই সমাজ ও রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে যাওয়া দুর্নীতির অবসান।