ইসলামে গুইসাপ ও দব (সান্ডা) খাওয়া নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই বিতর্ক রয়েছে। কেউ কেউ এটিকে হালাল বলে দাবি করলেও, ইসলামী শরিয়াহ এবং বিভিন্ন ফিকহের কিতাব অনুযায়ী এ জাতীয় প্রাণী ভক্ষণ করা হারাম বলে গণ্য করা হয়েছে—বিশেষ করে হানাফি মাযহাবের আলোকে। সান্ডা কেনো হারাম সে বিষয়টি সম্পূর্ণ বিস্তারিত ভাবে লিখেছেন গোপালগঞ্জ কালিনগর আওলাদুর-রসুল( সল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দরবার শরীফের প্রধান পীর সাহেব কেবলা আল্লামা সায়িয়্যদ আনিসুল আরেফিন।
“মাজমা’ আল-আনহার” এবং “আদ-দুররুল মুনতাকা”সহ বিভিন্ন প্রামাণ্য ইসলামি গ্রন্থে দব বা গুইসাপ জাতীয় প্রাণী খাওয়াকে হারাম বলা হয়েছে। কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, এগুলো ‘সিবাআ’ অর্থাৎ হিংস্র প্রাণী—যাদের দাঁত ও নখর দ্বারা শিকার করার স্বভাব আছে।
“আল-তানভীর” ও “আদ-দুররুল মুখতার” গ্রন্থে বলা হয়েছে, যে সমস্ত পশু দাঁত বা নখর দ্বারা শিকার করে, যেমন সিংহ, হায়েনা, শিয়াল, এমনকি গুইসাপ বা দব—এসব খাওয়া জায়েয নয়। আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেন “আর তিনি (আল্লাহ) তাদের জন্য মন্দ ও অপবিত্র বস্তুসমূহ হারাম করেছেন।” [সূরা আল আ’রাফ, আয়াত ১৫৭]
এই আয়াত নাজিল হওয়ার আগ পর্যন্ত রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এই প্রাণীগুলোর বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত দেননি। তবে পরে যখন এই আয়াত নাজিল হয়, তখন এগুলোকে হারাম ঘোষণা করা হয়।
ইবনে আবিদিন তাঁর “রাদ্দুল মুখতার” গ্রন্থে হাদীসের আলোকে উল্লেখ করেন, নবীজী (সা.) বলেছেন—”প্রত্যেক শিকারি দাঁতওয়ালা পশু এবং নখরওয়ালা পাখির গোশত খাওয়া হারাম।” হাদীসটি মুসলিম, আবু দাউদসহ একাধিক মুহাদ্দিস বর্ণনা করেছেন। ব্যাখ্যায় বলা হয়, এসব প্রাণীর স্বভাব হিংস্র ও অপবিত্র হওয়ায় মানুষের চরিত্রে প্রভাব ফেলতে পারে—এমন আশঙ্কা থেকেই নিষেধাজ্ঞা এসেছে।
ইমাম তাহাভির “শরহ মুশকিল আল-আসার”-এও উল্লেখ করা হয়েছে যে, গৃহপালিত গাধা, ঘোড়া, খচ্চর, হিংস্র প্রাণী ও শিকারি পাখি—সবই হারাম। জাবির (রা.) বর্ণিত হাদীসে পাওয়া যায়, খায়বার যুদ্ধে একবার সাহাবারা গৃহপালিত গাধার গোশত রান্না করেন, কিন্তু নবীজী (সা.) তা নিষিদ্ধ করেন এবং নির্দেশ দেন—পাত্র উলটে ফেলতে। তিনি বলেন, “আল্লাহ তোমাদের জন্য এমন কিছু রিজিক আনবেন, যা এর চেয়ে অধিক হালাল ও পবিত্র।”
অন্য একটি হাদীসে ইমাম জাফর আস-সাদিক (আ.) থেকে বর্ণিত, যেখানে তিনি বলেন, “গুইসাপ, ইঁদুর, বানর ও শূকর—সবই বিকৃত প্রাণী (মাসুখ) এবং এগুলো খাওয়া হারাম।”
অনেকে যে হাদীস দেখিয়ে গুইসাপ খাওয়াকে হালাল বলতে চেয়েছেন, যেমন: “উকিলাদ্দুব্বু আলা মায়িদাতি রাসুলিল্লাহ”, অর্থাৎ রাসুলের সামনে গুইসাপ খাওয়া হয়েছে—এই হাদীসের ব্যাখ্যায় হানাফি আলেমগণ বলেছেন, এটি ইসলাম পূর্ববর্তী সময়ে ঘটেছিল। এমনকি ঐ হাদীসে রাসুল (সা.) স্বয়ং বলেন: “আমি এটিকে হালালও বলছি না, হারামও বলছি না।” কিন্তু তাফসিরবিদদের মতে, এই বাক্যের মধ্যেই রয়েছে ‘হালিয়া ওয়াও’, যার দ্বারা ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে তিনি এটিকে নিজের জন্য হালাল করেননি।
এমনকি “আল-ইনায়াহ” ও অন্যান্য হানাফি কিতাবে মূলনীতি হিসেবে বলা হয়েছে: যখন হালাল ও হারামের মধ্যে সাংঘর্ষিক হাদীস পাওয়া যায়, তখন হারামের দিকটি প্রাধান্য পায়।
তাই, কুরআন, সহীহ হাদীস এবং হানাফি ফিকাহর আলোকে গুইসাপ ও দব (সান্ডা) জাতীয় হিংস্র প্রাণী খাওয়া স্পষ্টত হারাম। ইসলামের আদর্শ হলো পরিশুদ্ধ জীবনযাপন, যেখানে খাদ্যাভ্যাসকেও একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আল্লাহ বলেন, “তোমরা যা হালাল ও পবিত্র, তাই খাও।”