একজন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সাথে সাথেই জানতে পারার কথা আগামী কয়েক বছরের জন্য তার আবাসিক হল কী হচ্ছে, কোন রুমে সে থাকবে। কিন্তু গত ১৭ বছরে এর ব্যতিক্রম ছিল কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুবি)। তবে প্রতিষ্ঠার ১৮ বছর পরে এসে ‘হল এটাচমেন্টের’ দীর্ঘসূত্রিতার অবসান হতে যাচ্ছে।
প্রশাসনের বরাত দিয়ে জানা গেছে, ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা ভর্তির শুরু থেকেই নিজের আবাসিক হলের নাম জানতে পারবেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ২২ অক্টোবর উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোঃ হায়দার আলীর সভাপতিত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের কনফারেন্স রুমে হল প্রভোস্ট ও হাউজ টিউটরদের নিয়ে এক মতবিনিময় সভা করা হয়। মতবিনিময় সভায় শিক্ষার্থীদের ভর্তি হওয়ার সাথে সাথেই ‘হল এটাচ’ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং হলের আবাসন ও নানাবিধ সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত হলের প্রভোস্ট মো. জিয়া উদ্দিনকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি ঘোষণা করা হয়।
এ ব্যাপারে জিয়া উদ্দিন বলেন, “এটাচমেন্ট দেরিতে হওয়ার কারণে কোনো একটা ছেলের যখন ক্রাইসিস হয় বা কোনো কারণে তার হলে উঠতে হয় কিন্তু হলে উঠার ছয় বা সাত মাস পর সে যখন জানতে পারে তার অন্য হলে এটাচমেন্ট তখন পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রেক্ষিতে সে অন্য হলে যেতে অনীহা প্রকাশ করে। এই ধরনের সমস্যা নিরসনের লক্ষ্যেই আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যে, ভর্তির সাথে সাথেই যেন হল এটাচমেন্ট দিয়ে দেওয়া হয়।”
শিক্ষার্থী এবং প্রশাসনের সাথে কথা বলে জানা যায়, এর আগে একজন শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়ার ছয় মাস পর জানতে পারতেন সে কোন হলে এটাচমেন্ট পেয়েছে। ফলে আবাসিকতা থেকে শুরু করে নানান পর্যায়ে জটিলতা দেখা দিয়েছে। এমনকি একজন শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়ার শুরু থেকেই এক হলে থাকছে, কিন্তু ছয় মাস পর সে যখন জানতে পারে তার আবাসিকতা অন্য হলে তখন সেই হলে যাওয়ার সুযোগ থাকে না। এতে সেমিস্টার পরিক্ষা প্রদানের সময় কাগজপত্র স্বাক্ষর থেকে শুরু, নিরাপত্তাজনিত নানা পর্যায়ে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে।
এ ব্যাপারে লোক প্রশাসন বিভাগের ২০২১-২২ সেশনের শিক্ষার্থী ওবায়দুল হক বলেন, “একটা ছেলে ভর্তি হওয়ার তিন থেকে চার মাস পর জানতে পারে সে কোন হলে এলটেড হয়েছে, তো এমতাবস্থায় আমরা এই তিন চার মাস কোথায় থাকবো? আমাদের মধ্যে অনেকেই আছে যারা মেসের ভাড়া এবং খাবার বাবদ যে পরিমাণ টাকা প্রয়োজন সে পরিমাণ টাকা যোগান দিতে অনেক কষ্ট হয়ে যায়। অনেকে হয়তো পারেও না এজন্য যেকোনো এক হলে অবৈধভাবে উঠে যায়, পরে জানতে পারে এটা তার এলোটেড হল না। এখন কেউ ৪ মাস এক হলে থেকে অন্য হলে যেয়ে উঠাও তার পক্ষে অনেক দিক বিবেচনায় সম্ভবও হয়ে উঠে না।”
একই বর্ষের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী হামিদুর রহমান আজাদ বলেন, “বঙ্গবন্ধু হলে চার মাস থাকার পর জানতে পারি আমার হল এটাচমেন্ট নজরুল হলে। প্রশাসন তাঁর ইচ্ছে মত হল এটাচমেন্ট সংযুক্ত করে। তাও হলে থাকার চার পাঁচ মাস পর। ফলে আমরা যে হলে থাকি সে হলের আবাসিকতা আমাদেরকে দেওয়া হয় না। পরে আমরা পড়ি ভোগান্তিতে। তাছাড়া, যে হলে আমরা থাকি সে হলে আমাদের এটাচমেন্ট না দেওয়ায় আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগী।”
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলের সংখ্যা পাঁচটি। ছেলেদের জন্য তিনটি হলের বিপরীতে মেয়েদের জন্যে আছে দুইটি। তবে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের গৃহীত নতুন সিদ্ধান্তের ফলে সেই জটিলতা অনেকটাই লাঘব হবে বলে মনে করেন শিক্ষার্থীরা।
প্রশাসনের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী নিলয় সরকার বলেন, “হল এটাচমেন্টের যে একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া ছিল তা নিরসনে প্রশাসন যে উদ্যোগ নিয়েছেন তা যুগান্তকারী ও ফলপ্রসূ। এতে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি একেবারেই কমে যাবে।”
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ছেলেদের তিনটি হলে শিক্ষার্থীদের আবাসন আছে প্রায় ৭৬০ জনের। কিন্তু হল কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্যমতে, ছেলেদের তিনটি হলে আবাসিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৬১৭ জনের। প্রায় ১৪৩ জন শিক্ষার্থী অনাবাসিকভাবে হলে অবস্থান করছে। এর ফলে প্রতি মাসে হলে অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের যে মাসিক ১০০/১৫০ টাকা প্রদান করতে হয় এটা থেকে হল কর্তৃপক্ষ বঞ্চিত হচ্ছে। প্রশাসনের গৃহীত নতুন পদক্ষেপের ফলে রাজস্ব খাত তার প্রাপ্ত অর্থ থেকে বঞ্চিত হবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ ব্যাপারে অর্থ ও হিসাব দপ্তরের উপ-পরিচালক মোঃ নাছির উদ্দিন বলেন, “আমাদের কাছে শুধু আবাসিক শিক্ষার্থীদের একটা হিসাব থাকে। কিন্তু দেখা গেছে, হলগুলোতে যতজন শিক্ষার্থীর ক্যাপাসিটি আছে, সেই পরিমাণ অর্থ আমরা পাচ্ছি না। এর ফলে রাজস্ব খাত তার প্রাপ্ত অর্থ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। প্রশাসনের বর্তমান গৃহীত পদক্ষেপের ফলে রাজস্ব খাত তার প্রাপ্ত অর্থ থেকে বঞ্চিত হবে না।”
প্রশাসনের গৃহীত নতুন এই সিদ্ধান্তের ফলে ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীরা কোনো ধরনের জটিলতার সম্মুখীন হবে না। তবে ছেলেদের আবাসিক হলে এটাচমেন্ট ছাড়া প্রায় ১৪৩ জন শিক্ষার্থী অবস্থান করছে। পুরাতন শিক্ষার্থী যাদের কাগজে-কলমে এক হলে আবাসিক কিন্তু অবস্থানরত অন্য হলে, তাদের ব্যাপারেও আলোচনা হয়েছে বলে জানান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের প্রভোস্ট ড. মোহাম্মদ মাহমুদুল হাছান।
তিনি বলেন, “এটাচমেন্ট ছাড়া যারাই হলে অবস্থান করছে, এলোটেড হওয়ার জন্য তাদের একটা সুযোগ প্রদান করা হবে। এই ব্যাপারে আমরা একটা বিজ্ঞপ্তি দিব। বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী কেউ যদি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে এলোটেড না হয় তাহলে অবৈধভাবে সে আর হলে থাকতে পারবে না।”
এ ব্যাপারে রেজিস্ট্রার মোঃ মজিবুর রহমান মজুমদার বলেন, “আমরা দেখেছি যে, একজন শিক্ষার্থীর হল এটাচমেন্ট দেরিতে হওয়ার ফলে আবাসন থেকে শুরু করে সেমিস্টার পরিক্ষায় রেজিষ্ট্রেশনসহ নানা ক্ষেত্রে হয়রানির শিকার হয়। শিক্ষার্থীদের এই হয়রানি লাঘবের লক্ষ্যেই ভর্তি হওয়ার সাথে সাথে তাদের হল এটাচমেন্ট দিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। এরপর সীট খালি থাকার সাপেক্ষে যৌক্তিক উপায়ে তাদের আবাসন নিশ্চিত করা হবে।”
উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মাসুদা কামাল বলেন, “সিদ্ধান্ত হয়েছে হল এটাচমেন্ট ভর্তির সাথে সাথেই প্রদান করা হবে। আর সীট বরাদ্দ ও হল সংক্রান্ত অন্যান্য কার্যাবলী হল প্রভোস্টরা সমাধান করবেন।”
উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোঃ হায়দার আলী বলেন, “হল এটাচমেন্ট নিয়ে একটা জটিলতা তৈরি হয়েছে। এক হলের শিক্ষার্থীরা আরেক হলে অবস্থান করছে। আমরা সবকিছু একটা পাইপলাইনে এনে ঠিকঠাক করার চেষ্টা করছি। আশা করি খুব দ্রুত ঠিক হয়ে যাবে।”