দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর রেলওয়ের বেদখল হওয়া ভূমি উদ্ধারে অন্যান্য অঞ্চলে তৎপরতা দেখা গেলেও খুলনায় সে রকম কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।
ইতিমধ্যেযেসব জমি দখল করে স্থাপনা ও অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে, সেগুলো ৫ থেকে ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে সরিয়ে নিতে মন্ত্রণালয় নির্দেশনা দিলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের খুলনা বিভাগের ভূ-সম্পত্তি বিভাগ এখনো কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
তবে রেলের একাধিক কর্মকর্তা মনে করেন, বর্তমানে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পরিবেশ থাকায় জমি উদ্ধারের জন্য এটি উপযুক্ত সময়।
অনেকেই অভিযোগ করছেন, মাঝে মাঝে লোক দেখানো উচ্ছেদ অভিযান চালানো হলেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার পরও বেদখল জমি উদ্ধারে নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সাধারণ জনগণ।
অভিযোগ রয়েছে, রেলওয়ের কর্মকর্তাদের দুর্নীতির কারণেই জমি পুনরুদ্ধার সম্ভব হচ্ছে না। দখলদারদের কাছ থেকে নিয়মিত উৎকোচ গ্রহণের ফলে কোটি কোটি টাকার সরকারি সম্পত্তি হারিয়ে যাচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, খুলনা জংশনের দখলকৃত জমিতে সেমিপাকা, পাকা ও দ্বিতল ভবন নির্মিত হয়েছে। রেলওয়ের নথি অনুযায়ী, খুলনা জংশনে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ১০৪টি স্থাপনার আর্থিক মূল্য প্রায় ৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা। দখলদারদের নাম ও ঠিকানা জানা থাকা সত্ত্বেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
২০১৯ সালে হালনাগাদ করা রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চল খুলনা জেলার তথ্য অনুযায়ী, জেলার মোট সম্পত্তির পরিমাণ ১৪১৩.১৮ একর। এর মধ্যে অপারেশনাল কাজে ব্যবহৃত জমি ৪৬৪.৪ একর, বেদখল জমির পরিমাণ ৭৬.০৫ একর, কৃষি লাইসেন্সকৃত জমি ১৯৪.৯৪ একর, বাণিজ্যিক লাইসেন্সকৃত জমি ১৬.৮৯ একর, মৎস্য চাষের জন্য ২১.৪৬ একর, নার্সারির জন্য ০.৬৯৫৯ একর এবং অব্যবহৃত জমির পরিমাণ ৬১৫.৮২ একর।
খুলনা রেলওয়ের অধীনে ১৯টি স্টেশন রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেদখল রয়েছে রূপসা স্টেশনে (১৩৩.৩৬ একরের মধ্যে ১৫.৩৬ একর), রূপসা-মোংলায় (৬.৫০ একর), সামন্তসেনায় (৬.৬০ একর), বাহিরদিয়ায় (৫.৮০ একর), কর্ণপুরে (৩.৫৫ একর), বাগেরহাট কলেজ স্টেশনে (৪.১৩ একর), ষাটগম্বুজে (৩.৯৯ একর), তালতলার হাটে (৩.৬৬ একর), শিরোমণিতে (৩.০৪ একর) ও দৌলতপুরে (২.৫২ একর)। খুলনা ও খুলনা জংশনের দখলকৃত জমির পরিমাণ ৯.১৫ একর।
বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানও রেলের জমি দখল করে রেখেছে। এর মধ্যে খুলনা সিটি কর্পোরেশন (০.৩৫৮৫ একর), বিআইডব্লিউটিসি (০.৭৪১৯ একর), কেডিএ (০.৫৪৮০ একর), ফেরিঘাট বাস টার্মিনাল (১.০৩০ একর) এবং খুলনা মোটর বাস মালিক সমিতি (০.৪৮২০ একর) উল্লেখযোগ্য।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, বেদখল জমির অধিকাংশই প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দখলে রয়েছে। তারা এসব জমিতে অবৈধভাবে ভবন ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে এবং সেগুলো ভাড়া দিয়ে আয় করছে। রেলওয়ের ভূ-সম্পত্তি বিভাগ এ বিষয়ে অবগত থাকলেও কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি।
খুলনা রেলওয়ের পতিত জমির পরিমাণ ৬১৬ একর, যার মধ্যে রূপসা-মোংলায় ২৬৪ একর, রূপসায় ৭০ একর, যাত্রাপুরে ৫৯ একর এবং খুলনা জংশনে ২৭ একর রয়েছে। এসব জমিও অবৈধভাবে দখল হয়ে গেছে।
গত ২৪ ডিসেম্বর রেলওয়ের ভূ-সম্পত্তি বিভাগ থেকে অবৈধ দখলদারদের জমি ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে মাইকিং করা হয়। কিন্তু এরপরও কেউ জমি ছেড়ে দেয়নি এবং কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকেও কোনো কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি অধ্যাপিকা রমা রহমান বলেন, “খুলনার স্বার্থে রেলের সম্পত্তি উদ্ধার করতে হবে। রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি বেদখলে থাকা মানে রাষ্ট্রের ক্ষতি। তাই সরকার ও খুলনাবাসীকে এ বিষয়ে আন্তরিক হতে হবে।”
খুলনার জেলা ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা শাহিদুজ্জামান জানান, “আমি নতুন যোগদান করেছি এবং এখনো সবকিছু বুঝে উঠতে পারিনি। খুব দ্রুত মাইকিং করা হবে এবং দখলমুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।”
রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের বিভাগীয় ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা মোঃ আরিফুল ইসলাম জানান, “সরকারি নির্দেশনা পেলেও সতর্কতামূলক মাইকিং করা হয়নি। জমি উদ্ধারের আগে রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা না নিলে পুনরায় দখল হয়ে যায়। তবে কেউ স্থায়ী স্থাপনা তৈরি করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
আরইউএস