গাজা উপত্যকার লাখো মানুষ এখন ভয়াবহ মানবিক সংকটের মুখে। ইসরায়েলের দীর্ঘস্থায়ী অবরোধের ফলে টানা ১০ সপ্তাহের বেশি সময় ধরে খাদ্য ও ওষুধসহ জরুরি ত্রাণ প্রবেশ বন্ধ রয়েছে। ফলে গাজার সাধারণ মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন।
ক্ষুধার কষ্টে কাঁদছে শিশু ইসমাইল
বিবিসির এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে উত্তর গাজার একটি খাদ্য বিতরণ কেন্দ্রে ছয় বছর বয়সী ইসমাইল আবু ওদেহের হৃদয়বিদারক ঘটনা। সে বাটি হাতে চিৎকার করে খাবার চাইছিল। কিছু ডাল পেলেও ফেরার পথে তা পড়ে যায়। কান্নাভেজা মুখে সে ফিরে যায় তার পরিবারসহ আশ্রয় নেওয়া তাঁবুতে। পরদিনও তাদের ক্যাম্পে কোনো খাবার বা পানি পৌঁছায়নি। ইসমাইলের আশ্রয়স্থল এখন একটি স্কুল ভবনে গঠিত শরণার্থী শিবির, যেখানে মানুষ খালি বোতল ও পাত্র হাতে খাবারের জন্য অপেক্ষা করে।
দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে গাজা
বিবিসি জানায়, সাম্প্রতিক দিনগুলোতে তারা গাজার কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলেছে, যারা জানিয়েছেন, দিনে মাত্র একবেলার খাবার সংগ্রহ করাও দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। রান্নাঘরগুলো বন্ধ, বাজারে যেটুকু জিনিস পাওয়া যাচ্ছে, তার দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে।
এক স্বেচ্ছাসেবী জানান, তার রান্নাঘর ১০ দিন আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। উত্তর গাজার এক তরুণী জানান, খাবার ও ওষুধের অভাবে দুর্বলতা ও ক্লান্তি বাড়ছে।
৩১ বছর বয়সী আদহাম আল-বাতরাউই বলেন, ক্ষুধা এখন তাদের জীবনের অন্যতম কঠিন বিষয়। তিনি খাবার তৈরির জন্য নতুন নতুন উপায় খুঁজে বের করছেন—যেমন পাস্তা সিদ্ধ করে রুটির মতো কিছু বানানো।
মায়েদের সংগ্রাম ও বেঁচে থাকার লড়াই
গাজার দেইর আল-বালাহ শহরের নার্স রেওয়া মোহসেন জানান, তার তিন ও দেড় বছর বয়সী মেয়েদের নিয়ে প্রতিদিনের বেঁচে থাকা এক বড় চ্যালেঞ্জ। এক মাসের মধ্যে তার সংরক্ষিত ন্যাপকিনও ফুরিয়ে যাবে। তিনি বলেন, তার সন্তানরা বোমার শব্দে অভ্যস্ত হয়ে গেলেও, তিনি নিজে প্রতিটি শব্দে কেঁপে ওঠেন।
একটি বোমা হামলায় তাদের বাসার দরজা-জানালা উড়ে গেলে তিনি বলেন, “আল্লাহর রহমতে আমরা বেঁচে আছি, কিন্তু এখন কোথায় যাব?”
চিকিৎসা ব্যবস্থার বিপর্যয়
ইসরায়েলি হামলায় ইউরোপিয়ান হাসপাতাল ধ্বংস হওয়ার পর নার্স রান্ডা সাঈদ জানান, এটি ছিল এক নিখাদ আতঙ্কের অভিজ্ঞতা। রোগীদের স্থানান্তর করা হয়েছে নাসের হাসপাতালে, যেখানে প্রয়োজনীয় ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রীর ভয়াবহ সংকট চলছে।
তিনি বলেন, “এই রোগীরা আমাদের পরিবারের মতো। এখনই তাদের পাশে থাকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।”
বিতর্কিত মানবিক সহায়তা ব্যবস্থা
যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে, তারা গাজায় বেসরকারি কোম্পানির মাধ্যমে ত্রাণ সহায়তা পৌঁছানোর জন্য একটি নতুন পরিকল্পনা করছে, যেখানে ইসরায়েলি বাহিনী নিরাপত্তা দেবে। তবে জাতিসংঘ এটিকে ‘ত্রাণকে অস্ত্র বানানো’র অভিযোগ তুলে সমালোচনা করেছে।
একজন পিতার নিরুপায়তা
ইসমাইলের বাবা জানান, “আমার সন্তানরা না খেয়ে ঘুমায়। আমি তাদের জন্য কিছু করতে না পেরে কখনো কখনো একা বসে কাঁদি। তখন নিজেকে একেবারে ছোট শিশুর মতো মনে হয়।”
গাজার এই মানবিক বিপর্যয় আজ গোটা বিশ্বকে নাড়া দিচ্ছে। অথচ জীবন রক্ষাকারী ত্রাণ এখনও অবরুদ্ধ। গাজার মানুষ এখন শুধুই বেঁচে থাকার জন্য লড়ছে।