বিশ্ব রাজনীতিতে জনতুষ্টিবাদ (পপুলিজম) একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবণতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, বিশেষত ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে। একক মতাদর্শের চেয়ে ইস্যুভিত্তিক রাজনৈতিক কৌশল, জনপ্রিয় বক্তৃতা এবং জাতীয়তাবাদের ব্যবহার—এসবই জনতুষ্টিবাদী নেতাদের বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে।
জনতুষ্টিবাদ ও তার উত্থান
১৯২০ ও ১৯৩০-এর দশকে ইউরোপে জনতুষ্টিবাদের নতুন মাত্রা যোগ হয়। জার্মানির এডলফ হিটলার ও ইতালির বেনিতো মুসোলিনির নেতৃত্বে এটি রাজনৈতিকভাবে ব্যাপক বিস্তার লাভ করে। হিটলার তাঁর আত্মজীবনীতে স্বয়ং উল্লেখ করেছিলেন, বাগাড়ম্বরপূর্ণ বক্তৃতার মাধ্যমে জনতাকে প্রভাবিত করা সহজতর।
বর্তমান বিশ্বেও এই ধারা অব্যাহত রয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প, ভিক্টর অরবান, নরেন্দ্র মোদির মতো জনতুষ্টিবাদী রাজনীতির শক্তিশালী অনুসারীদের বক্তব্য ও নীতিতে জাতীয়তাবাদ, অভিবাসন বিরোধিতা এবং সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের পুনরুজ্জীবনের ওপর জোর দেওয়ার প্রবণতা আমাদেরকে এই কথাটিই স্মরণ করার সুযোগ করে দেয়।
উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন
জনতুষ্টিবাদী নেতারা সাধারণত উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকেন এবং সেগুলো বাস্তবায়নে আক্রমণাত্মক নীতি গ্রহণ করেন। যেমন, হিটলার জার্মান জাতির বিশুদ্ধতার কথা বারবার বলেছেন, আর ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ অভিবাসনের বিরুদ্ধে কঠোর নীতি গ্রহণ করেছেন।
এরই সূত্র ধরে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ট্রাম্প একটি নির্বাহী আদেশ জারি করে জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের নীতিতে পরিবর্তন আনেন, যা তাঁর কঠোর অভিবাসন নীতির অংশ। এ ধরনের সিদ্ধান্ত শুধু তাঁদের প্রতিশ্রুতি রক্ষার মধ্য দিয়ে ইমেজ বৃদ্ধি করে না, বরং ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক সমর্থনও নিশ্চিত করে।
জাতীয় অর্থনীতির ওপর গুরুত্ব
জনতুষ্টিবাদী রাজনীতিবিদরা সর্বদা দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে গুরুত্ব দেন। তাঁরা জাতীয় উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দেন, কর আরোপ করেন এবং আমদানি শুল্ক বৃদ্ধি করেন।
উদাহরণস্বরূপ, ব্রাজিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারো মুক্তবাজার অর্থনীতির চুক্তির পক্ষে ছিলেন। একইভাবে, ট্রাম্প প্রশাসন চীন, কানাডা ও মেক্সিকো থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করেছিল।
মূল্যবোধের প্রচার
জনতুষ্টিবাদীরা নিজেদের নির্দিষ্ট কিছু মূল্যবোধের ধারক হিসেবে তুলে ধরেন। জাতীয়তাবাদ, ধর্মীয় ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক পরিচয় রক্ষাকে তাঁরা তাঁদের প্রচারের মূল উপাদান হিসেবে ব্যবহার করেন।
হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান খ্রিস্টান মূল্যবোধ রক্ষার নামে অভিবাসনবিরোধী আইন প্রণয়ন করেছেন। নরেন্দ্র মোদি হিন্দু জাতীয়তাবাদের ওপর ভিত্তি করে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA) বাস্তবায়ন করেছেন। নিষিদ্ধ করেছেন গরুহত্যা। বলসোনারো ধর্মীয় মূল্যবোধকে সামনে রেখে মাদক ও সমকামিতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। ট্রাম্প তুমুল অভিবাসনবিরোধী হয়েছেন।
এই কৌশল জনগণের মধ্যে অতীতের গৌরবময় সময়ের স্মৃতি ফিরিয়ে আনে, যা জনতুষ্টিবাদীদের ভোটব্যাংককে শক্তিশালী করে।
আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে অবস্থান
জনতুষ্টিবাদীরা প্রায়ই আমলাতন্ত্রকে দুর্নীতিগ্রস্ত ও অকার্যকর বলে প্রচার করেন। তাঁরা সরাসরি জনগণের মতামতকে প্রাধান্য দেওয়ার দাবি করেন।
ট্রাম্প প্রশাসন আমলাতন্ত্রের ক্ষমতা খর্ব করতে নানা পরিবর্তন এনেছিল। বলসোনারোও সরকারি প্রতিষ্ঠানের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন। এর মাধ্যমে তাঁরা জনগণের কাছে নিজেদের প্রচলিত ব্যবস্থার বাইরে থাকা নেতা হিসেবে উপস্থাপন করেন, যা তাঁদের জনপ্রিয়তা বাড়ায়।
জনসাধারণের আবেগের ব্যবহার
জনতুষ্টিবাদীরা জনগণের আবেগকে দক্ষতার সঙ্গে কাজে লাগান। তাঁরা বিভিন্ন সংকট বা সামাজিক সমস্যাকে নির্দিষ্ট কোনো গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পরিচালিত করেন।
উদাহরণস্বরূপ, ইউরোপে অভিবাসন সংকটের সময় ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি, ভিক্টর অরবান এবং ব্রিটেনের বরিস জনসন ও ঋষি সুনাক অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন। ট্রাম্প প্রশাসনও অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে।
এই কৌশল জনসাধারণের সহানুভূতি অর্জনে কার্যকর ভূমিকা রাখে এবং জনতুষ্টিবাদীদের রাজনৈতিক শক্তি বৃদ্ধি করে।
জনতুষ্টিবাদীরা উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রতিশ্রুতি, জাতীয় অর্থনীতির প্রতি গুরুত্বারোপ, মূল্যবোধের প্রচার, আমলাতন্ত্রের প্রতি অবিশ্বাস এবং জনসাধারণের আবেগ ব্যবহারের মাধ্যমে নিজেদের জনপ্রিয়তা ধরে রাখেন।
ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির অধ্যাপক ইথেয়েল ডে সোলা পুল ১৯৬০-এর দশকে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, ২০১৮ সালের মধ্যে বিশ্ব থেকে ডানপন্থী জনতুষ্টিবাদের আবেদন কমে যাবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, এই প্রবণতা এখনো শক্তিশালী রয়ে গেছে।