মোঃ আয়নুল ইসলামঃ বাংলাদেশের রাজনৈতিক মানচিত্রে বিএনপি দীর্ঘদিন ধরেই বিরোধী রাজনীতির মুখপাত্র। ২০০৮ সালের পর দলটি আর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যেতে পারেনি। আন্দোলনের নানা কর্মসূচি, নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত ও রাজনৈতিক চাপে পড়ে দলটি ধীরে ধীরে মাঠ থেকে হারিয়ে যেতে বসেছিলো। ৫ই আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর আবারও বিএনপির জন্য সুযোগ তৈরি হয়েছে ক্ষমতায় যাওয়ার। এমতাবস্থায় বিএনপির কর্মী-সমর্থকরা ডিসেম্বরেই চায় জাতীয় নির্বাচন।
কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই নির্বাচনে অংশ নেওয়ার মতো প্রস্তুতি কি বিএনপির আছে? দল কি তার অভ্যন্তরীণ বিভক্তি ও সংকট কাটিয়ে নির্বাচনমুখী একটি ঐক্যবদ্ধ কাঠামো গড়ে তুলতে পেরেছে? বাস্তবতার দিকে ফিরে তাকালে হতাশারই প্রতিচ্ছবি মেলে।
গত এক দশকজুড়ে বিএনপির রাজনীতির কৌশল ছিল মূলত আন্দোলননির্ভর। তারা বারবার বলেছিলো—আওয়ামী সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচন বর্জনের পর স্পষ্ট হয়েছিলো, আন্দোলন দিয়ে সরকারকে সরিয়ে নির্বাচন আদায় করার কৌশল কার্যকর হয় না।
যে কোনো নির্বাচনে অংশ নিতে হলে প্রথমত দরকার সাংগঠনিক ঐক্য ও মনোবল। কিন্তু বিএনপির বর্তমান বাস্তবতায় অভ্যন্তরীণ কোন্দল সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি জেলা, উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়েও নেতৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব ও বিভাজন দেখা যাচ্ছে।
বিশেষ করে তারেক রহমানের প্রবাসে অবস্থান, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয়তা এবং স্থায়ী কমিটির সদস্যদের মধ্যে বোঝাপড়ার অভাব দলের মধ্যে কোন্দল বাড়াচ্ছে। যার ফলে তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা এবং হতাশা আরও বাড়ছে।
অন্যদিকে প্রার্থী বাছাই,মাঠ পর্যায়ে জনসংযোগ,৩১ দফার প্রচারনা—এসব বিষয়ে দলটির কোনো কার্যকরী উদ্যোগ নেই। এমনকি এখন পর্যন্ত কোনো নির্বাচনী কৌশলগত পরামর্শক দল কিংবা রাজনৈতিক গবেষণা সেল গঠনের ঘোষণা আসেনি, যেটি আধুনিক রাজনীতিতে একান্ত প্রয়োজনীয়।
গণতন্ত্রে বিরোধীদল শুধু সমালোচনা করেই থেমে থাকতে পারে না। তাদের দায়িত্ব হলো—রাষ্ট্রব্যবস্থার ভুলগুলো তুলে ধরা এবং তার বিকল্প প্রস্তাব হাজির করা। দুর্নীতি, সুশাসনের অভাব, দারিদ্র্য ও সামাজিক বৈষম্য নিয়ে কথা বলার পাশাপাশি এসব সমস্যার সমাধানে নিজেদের নীতিমালাও জনগণের সামনে তুলে ধরতে হয়। কিন্তু বিএনপির রাজনীতি এখনো “সরকারবিরোধী” অবস্থানের বাইরে বেরিয়ে আসতে পারছেনা অনেকক্ষেত্রে। শুধু সরকারবিরোধী বক্তব্য আর বিক্ষোভের রাজনীতি দিয়ে জনগণের আস্থা ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়।
এমতাবস্থায় যদি দলটি শুধু নির্বাচন নিয়ে কথা বলে, কিন্তু প্রস্তুতি না নেয়, তাহলে সেটি একদিকে যেমন কর্মীদের হতাশ করবে, তেমনি সাধারণ জনগণকেও বিভ্রান্ত করবে।
ডিসেম্বরে নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা বাস্তবতায় নেই। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ঘোষণা অনুযায়ী এপ্রিলেই হয়তো হবে নির্বাচন। বিএনপির এখন জরুরি কাজ হচ্ছে – অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসন, সাংগঠনিক শক্তি পুনর্গঠন, নির্বাচনের জন্য দৃশ্যমান প্রস্তুতি শুরু করা ও প্রতিটি আসনে দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রার্থী চূড়ান্ত করে জনসংযোগ শুরু করা।
বর্তমানে তৃণমূল পর্যায়ে কমিটি পুনর্গঠন, সম্ভাব্য প্রার্থী চূড়ান্তকরণ, জনসংযোগ জোরদার এবং যুগোপযোগী রাজনৈতিক বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই।
সময়ের চাকা থেমে থাকে না। নির্বাচনের সময় দ্রুত এগিয়ে আসছে। বিএনপির সামনে এখন দুইটি পথ একটি হলো দ্বিধা-দ্বন্দ্বে সময় নষ্ট করে রাজনীতির প্রান্তে ছিটকে পড়া, আর অন্যটি হলো মাঠে নামা, সংগঠিত হওয়া এবং জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করা। এখন দেখার বিষয় বিএনপি কোন পথ বেছে নেয়।
লেখকঃ শিক্ষার্থী, রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়