মোহাম্মদ নিলয়, ক্রীড়া প্রতিবেদকঃ
প্যারিস সেন্ট-জার্মেইনের (PSG) নাম শুনলেই কয়েক বছর আগেও চোখের সামনে ভেসে উঠতো তিন মহাতারকার সমন্বয়ে গড়া কাল্পনিক এক দল। আর্জেন্টাইন সুপারস্টার তথা বিশ্ব ফুটবলের কিংবদন্তি লিওনেল মেসি ব্রাজিলিয়ান তারকা নেইমার জুনিয়র এবং ফরাসী তারকা কিলিয়ান এমবাপ্পে, তারা একসঙ্গে মাঠে নামলে মনে হতো কোন কাল্পনিক দল খেলছে। যেনো ম্যাচ শুরুর আগেই হেরে বসে থকতো বিপক্ষ দল। কিন্তু বাস্তবতা ছিলো একেবারেই ভিন্ন। বিশ্ব ফুটবলের এই তিন তারকা’কে নিয়েও চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে যেতে পারে নি ফরাসী জায়ন্ট পিএসজি। বর্তমানে সবাই পিএসজি ছেড়ে আছেন ভিন্ন ভিন্ন ক্লাবে। তাদের অনুপুস্থিতেই ভাগ্য খুলেছে ফরাসী এই ক্লাবটির। চলতি মৌসুমে আর্সেনালকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনাল নিশ্চিত করেছে লুইস এনরিকের দল। তবে কি অপেয়া ছিলেন মেসি নেইমার এমবাপ্পেরা?
২০২১ সালে মেসির আগমন, ২০১৭ সালে নেইমারের রেকর্ড ট্রান্সফার আর এমবাপ্পে লোকাল ফুটবলার হিসেবে আগ থেকেই ছিলেন দলে। সবকিছু মিলিয়ে ইউরোপীয় ফুটবলে PSG হয়ে উঠেছিল সুপারস্টার-নির্ভর অপ্রতিরোধ্য এক দল , কিন্তু আক্রমণ ভাগে শক্তিশালী লেজেন্ডরা থাকার পরেও ফলাফল বের হয়নি চাহিদা অনুযায়ী। তিনজনে একসঙ্গে অনেক ম্যাচ খেলেছেন, গোল করেছে্ন,সংবাদের শিরোনাম হয়েছেন, কিন্তু সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত ইউরোপীয়ন ট্রফি UEFA চ্যাম্পিয়নস লিগ ধরা দেয়নি তাদের সময়ে। তখন প্রশ্ন তোলা হতো কোচের পরিকল্পনা, ডিফেন্সের দুর্বলতা, দলের ভারসাম্যহীনতা নিয়ে, কিন্তু কখনওই ত্রয়ীকে দোষারোপ করার সাহস কেউ দেখাতো না, কারণ তারা ছিল ফুটবল বিশ্বের পোস্টার বয়, একেকজন একেক যুগের প্রতিনিধিত্বকারী চরিত্র।
কিন্তু সময়ের স্রোতে দৃশ্যপট বদলে গেল। নেইমার ইনজুরিতে জর্জরিত হয়ে ২০২৩ সালে সৌদি আরবের ক্লাব আল-হিলালে পাড়ি জমালেন, মেসি চলে গেলেন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টার মিয়ামিতে আর এমবাপ্পে বহু কাঙ্ক্ষিত ট্রান্সফারে ২০২৪-২৫ মৌসুমে যোগ দিলেন রিয়াল মাদ্রিদে। যাদের নিয়ে PSG গর্ব করতো, তারাই একে একে বিদায় নিলেন, যেখানে দলটি ভেঙে পড়ার কথা সেখানে দেখা গেল উল্টো দৃশ্য, তিন ফুটবলারের বিদায়ের পর PSG যেন পুনর্জন্ম নিল এক নতুন রূপে, যেখানে দলে নেই কোনো অতি-মহাতারকা, নেই কোনো ব্যক্তিগত অহংবোধের কোন্দল, বরং আছে একঝাঁক কর্মঠ, পরিশ্রমী ও কৌশলগতভাবে আত্মবিশ্বাসে পরিপূর্ণ খেলোয়াড়, যারা দলের জন্য খেলে, নিজেদের জন্য নয়। কোচ লুইস এনরিক এর নেতৃত্বে তৈরি হওয়া এই নতুন PSG দলটি মাঠে নামছে একটি লক্ষ্য নিয়ে, একসঙ্গে লড়ছে, একে অপরকে কভার দিচ্ছে, কোনো একজন নয়, সবাই নায়ক হচ্ছে, আর তারই ফলস্বরূপ তারা এবার চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে পৌঁছে গেছে, যেটা মেসি-নেইমার-এমবাপ্পে যুগে কেবল স্বপ্নই ছিল। প্রশ্ন উঠতেই পারে—তাহলে কি এই ত্রয়ী ছিল PSG-র জন্য একধরনের ‘অপেয়া’?
বলা হয়, একজন খেলোয়াড় ভালো হলে সে ম্যাচ জেতাতে পারে, কিন্তু দল জিততে হলে প্রয়োজন দলগত চেষ্টার, সবার সম্মিলিত প্রয়াসের। PSG হয়তো এখন সেই বাস্তবতা বুঝেছে। মেসি, নেইমার, এমবাপ্পে তিনজনেই অসাধারণ, কিন্তু তারা যেন একে অপরের পাশে নিজেদের সবটা দিতে পারেননি। কেউই পেছনে সরে গিয়ে অপরজনকে জায়গা করে দিতে চাননি, বরং সবাই চেয়েছিলেন নায়ক হতে, যার ফলে মাঠে দেখা যেতো বিভ্রান্তিকর পাস, অকারণ গোল মিস, আর গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে ঝিমিয়ে যাওয়া একটা আক্রমণভাগ। আর যখন মাঠে তিনজনের মধ্যে কেউ ইনজুরিতে থাকতেন, তখন দলের ছন্দ যেন খানিকটা ফিরে পেতো। ত্রয়ী থাকার সময় PSG ছিল এক ‘অল স্টার স্কোয়াড’, কিন্তু ‘টিম’ নয়। আর এখনকার PSG তারকাহীন, কিন্তু ‘টিম’ হিসেবে তারা অনেক বেশি ভয়ংকর, প্রতিপক্ষের জন্য বিপজ্জনক। ২০২৫ সালের চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে ওঠা PSG প্রমাণ করে দিয়েছে যে বড় তারকার চেয়ে বড় কিছু হলো বোঝাপড়া, একতাবদ্ধতা আর মাঠে নির্দিষ্ট ছক মেনে খেলা।
আজকে যারা দলে আছেন—ওসমান ডেম্বেলে, গনসালো রামোস, ভিতিনহা, উগার্তে, লুকাস হেরনান্দেজ, হাকিমি—তাদের কেউই হয়তো ব্যালন ডি’অর ফাইনালিস্ট নয়, কিন্তু তারা একে অপরের পাশে খেলেন নির্ভরতার প্রতীক হয়ে, যা ত্রয়ীর সময় দেখা যেতো না। আর এখানেই হয়তো মেসি-নেইমার-এমবাপ্পের অপূর্ণতা লুকিয়ে আছে। তারা আলাদা করে একেকজন মহাতারকা, কিন্তু একসঙ্গে তারা হতে পারেননি একটি সম্পূর্ণ দল। এক্ষেত্রে PSG হয়তো আজ বুঝে গেছে, অতীতের সেই ত্রয়ী ছিল একঝলক বজ্রপাত, আলো ছিল, শব্দ ছিল, কিন্তু বারিধারা ছিল না, ফল ছিল না। তাই হয়তো এটাই বলার সময়—হ্যাঁ, তারা হয়তো ‘অপেয়া’ ছিল না ইচ্ছাকৃতভাবে, কিন্তু বাস্তবতার দৃষ্টিকোণে তারা PSG-র ইউরোপীয় সাফল্যের পথে এক বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, যার অবসানে আজ ক্লাবটি নতুন আশার আলো দেখছে।