বৈশ্বিকভাবে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক শক্তির জটিলতার প্রেক্ষিতে সাম্প্র্রতিক সময়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের শঙ্কা অনেক বেশি উচ্চারিত হচ্ছে। বিশেষ করে ইউরোপের ভূ-রাজনৈতিক সংকট, চীন-তাইওয়ান দ্বন্দ্ব, মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতা এবং পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলোর ক্রমবর্ধমান সামরিক শক্তি প্রদর্শন পৃথিবীকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। অতীতের দুটি বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব পড়েছিল সমগ্র বিশ্বের ওপর। অনেক জায়গার মানুষ এখনো সেই পরিস্থিতি থেকে বেরোতে পারেননি। এর মধ্যে যদি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় তাহলে পৃথিবী ধ্বংসের শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছাবে।
ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে চলমান সংঘাতের পরিধি প্রতিনিয়ত বিস্তৃত হচ্ছে। গত ১ অক্টোবর ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে প্রায় ২০০টি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে ইরান। এর আগের দিন ইরান সফর করে পুতিনের সমর্থনের কথা জানান দেন রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী। হামলার পর প্রকাশ্যে ইসরায়েলকে সমর্থন করার কথা জানিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
গত এক বছর ধরে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধ চলছে। হিজবুল্লাহর ঘাঁটিকে লক্ষ্য করে স্থলপথে লেবাননেও হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। ক্রমাগত বেড়ে চলা এই সংঘর্ষ কেন্দ্র করে আরব দেশগুলোর পাশাপাশি বিশ্বের অনেক দেশই স্পষ্টতই বিভক্ত।
তার ওপর গত ২৮ সেপ্টেম্বর ইসরায়েলি হামলায় হিজবুল্লাহর নেতা হাসান নাসরাল্লাহর মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করার পর মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত আরও গুরুতর আকার ধারণ করেছে।
এদিকে ইসরায়েলে হামলার পরপরই শুক্রবার জুম্মার নামাযের খুতবায় ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি বলেছেন, মুসলিমদের শত্রু অভিন্ন এবং ইসরায়েলে চালানো ইরানের হামলা ছিল ‘ন্যূনতম শাস্তি’। প্রায় পাঁচ বছর পর জুমার নামাজের ইমামতি এবং খুতবায় দাঁড়িয়ে তিনি এসব কথা বলেন। ভাষণে দুইবার তিনি জোর দিয়ে বলেন, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে পদক্ষেপের প্রশ্নে ইরান কোনো দ্বিধা বা বিলম্ব করবে না।
তিনি বলেন, তার দেশ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ‘দৃঢ় ও শক্তিশালী’ পদক্ষেপ নিতে যা করা প্রয়োজন তাই করবে।
সবমিলিয়ে বর্তমান বিশ্বের ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট অত্যন্ত জটিল এবং অস্থির। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুধু ইউরোপেই নয়, সমগ্র বিশ্বের জন্য একটি গুরুতর হুমকি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। রাশিয়া ও পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে বিদ্যমান দ্বন্দ্বের ফলে যে বৈশ্বিক সংকট তৈরি হয়েছে, তা থেকে নতুন কোনো বড় ধরনের সংঘাতের সৃষ্টি হতে পারে। ন্যাটোর সম্প্রসারণ এবং রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া, বিশেষ করে পারমাণবিক অস্ত্রের হুমকি, বিশ্বকে একটি নতুন ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারে।
পাশাপাশি, চীন ও তাইওয়ান ইস্যুও বৈশ্বিক উত্তেজনার অন্যতম উৎস। চীন তাইওয়ানকে তাদের নিজেদের অংশ হিসেবে দাবি করে এবং তাদের স্বাধীনতাকে স্বীকার করে না। এদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে তাইওয়ানের পক্ষ নিয়েছে।
ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সরাসরি যুদ্ধের সম্ভাবনা রয়েছে, যা আবার যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার মতো বড় শক্তিগুলোকেও সংঘাতে জড়াতে পারে।
বিশ্বব্যাপী পারমাণবিক অস্ত্রের পরিমাণ এবং এর ব্যবহারের সম্ভাবনা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঝুঁকি বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে কৌশলগত উত্তেজনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, এবং অন্যান্য পারমাণবিক দেশগুলোর মধ্যে চলমান ক্ষমতার লড়াইয়ের ফলে পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার নতুন একটি যুদ্ধের সূচনা করতে পারে। পারমাণবিক যুদ্ধ মানব সভ্যতার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। একটি পূর্ণাঙ্গ পারমাণবিক যুদ্ধ পৃথিবীর পরিবেশকে ধ্বংস করে দিতে পারে, খাদ্য ও পানির অভাব তৈরি করতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদি রেডিয়েশন ক্ষতির কারণে মানুষের জীবনের জন্য একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহারের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী যে বিপর্যয় সৃষ্টি হবে, তা নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত কঠিন হবে।
বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ এড়াতে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর মধ্যে সমঝোতা এবং সংলাপের মাধ্যমে উত্তেজনা কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে। জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর ভূমিকা এখানে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। বড় শক্তিগুলোকে পারস্পরিক স্বার্থে সমঝোতার পথে হাঁটতে হবে, যাতে কোনো সামরিক সংঘাত না ঘটে এবং পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহারের হুমকি থেকে বিশ্ব মুক্ত থাকে। বিশেষ করে পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার রোধে এবং অস্ত্র প্রতিযোগিতা কমাতে আন্তর্জাতিক চুক্তির প্রয়োজন রয়েছে।