মো. পারভেজ সেখ: একটি বিকট বিস্ফোরণ। তাপমাত্রা ৪,০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। চোখ ধাঁধানো আলো। মুহূর্তেই উড়ে যায় লাখো প্রাণ, ধ্বংস হয় একটি শহর। এই এক বিস্ফোরণ বদলে দিতে পারে মানবসভ্যতার ভবিষ্যৎ।
বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে যে অস্ত্র একবার পৃথিবীতে আবির্ভূত হলো, তা আর থেমে থাকেনি। ধাপে ধাপে, কৌশলে, গোপনে এবং প্রকাশ্যে পারমাণবিক অস্ত্র হয়ে উঠেছে আধুনিক বিশ্বের সবচেয়ে বড় হুমকি। আজকের এই সভ্যতা যার ভিত্তি প্রযুক্তি, ভূরাজনীতি ও প্রতিযোগিতার ওপর গড়ে উঠেছে, তার গোপন ছায়া হচ্ছে এই পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে আমেরিকা যুক্তরাজ্যের সহযোগিতায় ‘ম্যানহাটন প্রজেক্ট’ নামক এক গোপন প্রকল্পের মাধ্যমে পারমাণবিক বোমা তৈরি করে। ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট ও ৯ আগস্ট, এই দুই দিনে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে ফেলা হয় দুটি পারমাণবিক বোমা। প্রায় ২ লাখ মানুষ মুহূর্তে মারা যায়। অসংখ্য মানুষ পঙ্গু হয়ে পড়ে তেজস্ক্রিয়তার প্রভাবে। এ ঘটনাই বিশ্বকে জানিয়ে দেয় মানবজাতি এমন এক অস্ত্র তৈরি করেছে, যা তার নিজের অস্তিত্বকে মুহুর্তেই ধ্বংস করতে পারে।
হিরোশিমার বিস্ফোরণের ভয়াবহতার কয়েক বছরের মধ্যেই সোভিয়েত ইউনিয়নও পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করে। এরপর শুরু হয় দীর্ঘ শীতল যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্র বনাম সোভিয়েত ইউনিয়ন। তারা একে অপরকে টেক্কা দিতে শুরু করে পারমাণবিক অস্ত্র মজুদের প্রতিযোগিতা।
এই সময়ই তৈরি হয় “MAD” (Mutually Assured Destruction) তত্ত্ব অর্থাৎ দুই পক্ষই জানে, যদি কেউ প্রথমে হামলা করে তবে প্রতিপক্ষও পাল্টা আঘাত করবে। ফলে উভয়পক্ষ ধ্বংস হবে। এই ভয়ংকর কৌশলগত “ভারসাম্য”ই পৃথিবীকে বড় যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া থেকে ঠেকিয়ে রেখেছে। কিন্তু এক অনিশ্চয়তার ছায়া বিস্তার করে আছে পুরো মানবসভ্যতার ওপর।
যদিও এই পারমাণবিক অস্ত্র একসময় কেবল দুটি বা তিনটি দেশের হাতে ছিল। কিন্তু আজ তা ছড়িয়ে পড়েছে অন্তত ৯টি রাষ্ট্রের হাতে। এই তালিকায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ভারত, পাকিস্তান, উত্তর কোরিয়া এবং সম্ভবত ইসরায়েল। অনেক সামরিক বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন, ইরানও পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। এদের মধ্যে আবার রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের হাতে রয়েছে পৃথিবীর প্রায় ৯০% পারমাণবিক অস্ত্র।
পারমাণবিক অস্ত্রধারী রাষ্ট্রগুলো একে অপরকে ভয় দেখাতে পারে, চাপে রাখতে পারে, এমনকি বিভিন্নভাবে কূটনৈতিক সুবিধাও আদায় করতে পারে। কিন্তু এর সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে দুর্ঘটনার আশঙ্কা, বাড়ছে ভুল বোঝাবুঝির ঝুঁকি, বাড়ছে মানবজাতিকে অনিবার্য ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়ার সম্ভাবনা।
তবে এখন আর কেউ সরাসরি পারমাণবিক যুদ্ধ চায় না। কারণ তার ফলাফল কেউই সামাল দিতে পারবে না। তাই এখন পারমাণবিক অস্ত্র হয়ে উঠেছে এক ধরনের “কৌশলগত পলিসি” যাতে একটি দেশ প্রতিপক্ষের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ, উত্তর কোরিয়া একটি দরিদ্র ও নিঃসঙ্গ রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও তার পারমাণবিক অস্ত্রের কারণে বড় বড় পরাশক্তির চোখে গুরুত্ব পায়। অন্যদিকে, ইরান দীর্ঘদিন ধরে পারমাণবিক কর্মসূচির মাধ্যমে কূটনৈতিক উত্তেজনার কেন্দ্রে রয়েছে।
পারমাণবিক অস্ত্রের কৌশলগত গুরুত্ব যতই থাকুক, তার মানবিক মূল্য ভয়াবহ। শুধু হিরোশিমা-নাগাসাকি নয়, বিভিন্ন পারমাণবিক পরীক্ষা, দুর্ঘটনা ও বিস্ফোরণে বহু সাধারণ মানুষ দীর্ঘমেয়াদী ক্যানসার, জন্মগত ত্রুটি, তেজস্ক্রিয়তার সংক্রমণসহ নানা বিপর্যয়ের শিকার হয়েছেন।
১৯৮৬ সালে চেরনোবিলের দুর্ঘটনা কিংবা ২০১১ সালের জাপানের ফুকুশিমা ট্র্যাজেডি প্রমাণ করে দেয় যে, তেজস্ক্রিয়তা নিয়ন্ত্রণ করা মানুষের আয়ত্তের বাইরে চলে যেতে পারে মুহূর্তেই।
জাতিসংঘ দীর্ঘদিন ধরে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। ১৯৬৮ সালের পারমাণবিক অস্ত্র অপ্রসারণ চুক্তি (NPT), ১৯৯৬ সালের পরীক্ষা নিষিদ্ধকরণ চুক্তি (CTBT), ও সাম্প্রতিক Treaty on the Prohibition of Nuclear Weapons (TPNW)—এই সব উদ্যোগ বিশ্বকে পারমাণবিক মুক্ত করার স্বপ্ন দেখালেও তা বাস্তব রূপ পায়নি।
বড় বড় শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো নিজেরাই এই চুক্তিতে অংশ নেয় না কিংবা এতে স্বাক্ষর করলেও বাস্তবে অস্ত্র মজুদ চালিয়ে যায়।
বিশ্ব এখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে প্রবেশ করছে। তাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, সাইবার যুদ্ধ এই সব নতুন নতুন প্রযুক্তি পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবস্থাপনার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে, যা নতুন ঝুঁকি তৈরি করছে। যদি কোনো স্বচালিত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সিস্টেম ভুলভাবে পারমাণবিক অস্ত্র সক্রিয় করে, তবে তার ফল হতে পারে মানব সভ্যতার অন্তিম অধ্যায়।
তা ছাড়া, সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বা অনিরাপদ রাষ্ট্রের হাতে পারমাণবিক প্রযুক্তি চলে যাওয়ার আশঙ্কাও অস্বীকার করা যায় না।
এ কারণে, এই সভ্যতায় কেবল নতুন প্রযুক্তি নয়, নতুন চিন্তাভাবনারও প্রয়োজন। যুদ্ধ নয়, শান্তি হোক কূটনীতির প্রধান ভাষা। প্রতিযোগিতা নয়, সহযোগিতা হোক বৈশ্বিক নীতির ভিত্তি। আর পারমাণবিক অস্ত্রকে শক্তির প্রতীক নয়, মানবতার ব্যর্থতার চিহ্ন হিসেবে বিবেচনা করা হোক।
কারণ, পৃথিবী একটিই। এই গ্রহেই আমাদের সবার ঠাঁই। আর একটি ভুল সিদ্ধান্ত, একটি ভুল বোতাম চাপা, কিংবা একটি রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের ভ্রান্তি সব কিছু শেষ করে দিতে পারে।
আমাদের সামনে এখনো সময় আছে পারমাণবিক অভিশাপ থেকে বেরিয়ে এসে নতুন এক আশার পৃথিবী গড়ে তোলার।
লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়,রংপুর
ইমেইল:sajjadparvez6969@gmail.com