“১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর থানার (বর্তমানে উপজেলার) সোনতনী ইউয়নাধীন ধীতপুর নামক স্থানে পাকিস্তানি হানাদার সৈন্য, মিলিশিয়া ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের একটি যুদ্ধ হয়েছিল। তখন আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয় ছিল দাড়প্রান্তে। আমরা প্রতি ক্ষনে ভাবছিলাম পরবতীর্ সূর্য উদিত হওয়ার পূর্বেই বাংলাদেশ স্বাধীন হবে। ২১ নভেম্বর মুক্তি বাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে যৌথ বাহিনী গঠন করা হয়েছিল। ৪ ডিসেম্বর থেকে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনী বিভিন্ন রণাঙ্গনে যৌথ ভাবে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিল। ৬ ডিসেম্বর প্রথমে ভূটান ও পরে ভারত আমাদের বাংলাদেশ কে স্বীকৃতি দিয়েছে। সারাদেশের স্বাধীনতা বিরোধীরা দেশ ও বিদেশে পালিয়ে যাওয়া শুরু করেছে।
রাজাকারেরা বিভিন্ন ক্যাম্প ছেড়ে অস্ত্র সহ অথবা অস্ত্র বিহীন মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পন করছে। যারা হিন্দুদের মালামাল লুট করে নিয়েছিল তারা লুটের মাল হিন্দুদের কে ফেরত দিয়ে মিল করছে। স্বাধীনতার পক্ষ বিপক্ষ মানুষ পরস্পর মিল করছে। আমাদের গ্রামের একমাত্র রাজাকার ছিল বাইনা রাজাকার। সে করশালিকা রাজাকার ক্যাম্পে ভর্তি হয়েছিল। সে আমার খোঁজ পেয়ে তার সাথী আর কয়েক জন রাজাকার কে সাথে নিয়ে এসেছে আত্মসর্মপ করার পরামর্শ নিতে। ১২ ডিসেম্বর টাঙ্গাইলের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে যমুনা নদী পাড় হয়ে এক প্লাটুন পাকিস্তানি সৈন্য ও মিলেশিয়া মালিপাড়া রাজাকার ক্যাম্পে এসেছে। মালিপাড়া রাজাকার ক্যাম্প থেকে পথ চিনানোর জন্য দুইজন রাজাকার কে সাথে নিয়েছে। ওয়াপদা বাঁধ ধরে পালিয়ে যাচ্ছে।
১২ ডিসেম্বর আমাদের গ্রুপটি ছিল সৈয়দপুর নামক গ্রামে। ১৩ ডিসেম্বর সকালে কয়েক জন যুবক এসে আমাদের কে পাকিস্তানি সৈন্যদের পালানোর খবর দিল। সংবাদ পেয়ে কৈজুরী গ্রাম থেকে আমরা পাকিস্তানি সৈন্যদের পিছু নিলাম। তখন আমাদের কমান্ডার ছিলেন রবীন্দ্র নাথ বাগচী। কমান্ডারের নির্দেশ ছিল, পাকিস্তানি সৈন্যরা পালিয়ে যাচ্ছে। ওরা আমাদের লোকজনদের কোন ক্ষতি না করলে। আমরা ওদের কে আক্রমণ করবো না। পাকিস্তানি সৈন্যরা ওয়াপদা বাঁধ ধরে বেড়া থানার দিকে যাচ্ছিল। আমরা নিরাপদ দূরতে¦ থেকে গোপন পথে ওদেরকে ফলো করে চলচ্ছিলাম। পাকিস্তানি সৈন্যরা ছিল ক্ষুধার্ত। ওরা কৈজুরীর এক কৃষকের ক্ষেত থেকে মুলা তুলে খাওয়ার চেষ্টা করল। ওরা ভীষন ক্রোধি। ধীতপুর গ্রামের কাছে গিয়ে ওরা আমাদের কে দেখে ফেললো। ওরা আমাদের দিকে অস্ত্র উচিয়ে ধরলো। আমরা জাম্প করে ওয়াপদা বাঁধের পশ্চিম পাশে পজিশন নিলাম। ওরাও জাম্প করে বাঁধের পূর্ব পাশে পজিশন নিল। ওরা পজিশন নিয়ে আমাদের উপর গুলি চালাতে থাকলো। শুরু হলো গুলি ও পাল্টা গুলি।
পাকিস্তানি সৈন্যরা ছিল পেশাদার, প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ও আধুনিক অস্ত্র—শস্ত্রে সজ্জিত। ওদের সাথে যুদ্ধ করে বিজয়ী হওয়া খুব কঠিন ছিল। ওরা আমাদের উপর বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়তে থাকলো। কি ভয়াবহ যুদ্ধ। আমার মাথার ওপর দিয়ে চো—চো করে গুলি যাচ্ছে। এ যুদ্ধে পরাজিত হলে ওরা সবাইকে ওরা নৃশংস ভাবে হত্যা করবে। আমাদের গ্রুপ কমান্ডার ছিলেন রবীন্দ্র নাথ বাগচী। তিনি এল.এম.জি চালাচ্ছিলেন। তাঁর ডান পাশে ছিল আমার অবস্থান। আমি থ্রি—নট—থ্রি রাইফেল চালাচ্ছিলাম। আমাদের যুদ্ধের সংবাদ শুনে শাহজাদপুরের কাদাই বাদলা গ্রামের মো: সিরাজুল ইসলাম এর গ্রুপ, উল্টাভাব গ্রামের জনাব মো: আব্দুল হাই এর গ্রুপ ও অন্যান্য গ্রুপ। বেড়া থানার এস.এম. আমির হোসেন এর গ্রুপ, ঘাটাবাড়ির জনাব মো: বজলুল করিম দুলাল এর গ্রুপ।
বেলকুচি ও চৌহালী থানার অন্যান্য গ্রুপ এসে আমাদের সাথে যোগ দিয়েছিলেন। গোলা গুলির এক পর্যায়ে আমাদের পক্ষের বেড়ার এস.এম. আমির হোসেনের গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধা বৃশালিকা গ্রামের অধিবাসী ও বেড়া বিবি হাই স্কুলে দশম শ্রেণির ছাত্র জনাব মো: আব্দুল খালেক ও ছেচানিয়া গ্রামের অধিবাসী মো: আমজাদ হোসেন গুলি বৃদ্ধ হলেন। দুইটা গুলি এসে আমার হেলমেটে লাগলো। আমার পাশেই গুরুতর আহত বীর মুক্তিযোদ্ধা দুইজন যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছিলেন। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা কেহ কেহ তাদের যন্ত্রনা লাঘবের চেষ্টা করছেন। যুদ্ধও বন্ধ করা যাবে না। যুদ্ধ বন্ধ করলে পাকিস্তানি সৈন্যরা আমাদের ধরে ফেলবে। আমি ও অন্যান্যরা সবাই গুলি চালিয়ে যাচ্ছি। এর মধ্যে অন্ধকার নেমে এলো। পাকিস্তানি সৈন্যরা গুলি করা প্রায় বন্ধ করলো। ওদের দেখা দেখি আমরাও গুলি করা বন্ধ করলাম।
সারারাত আমরা না খেয়ে পজিশন অবস্থায় থাকলাম। রাতে রাজাকার দ’ুজন মাঝে মাঝে দুই একটা কভারিং ফায়ার করছে। তাদের গুলির কারণে আমরাও ২/১ টা করে গুলি করছি। ভোরে আমাদের কমান্ডার ও অন্যান্যরা রাজাকার দু’জন কে ঘিরে ধরে সারেন্ডার করালেন। তাদের কাছ থেকে অস্ত্র নিয়ে নেওয়া হলো। রাজাকার দুই জনের কাছ থেকে জানা গেল। রাত ১২ টার দিকে পাকিস্তানি সৈন্যরা ক্রোলিং করে পিছিয়ে এসে রাজাকার দুই জন কে কভারিং ফায়ারের নির্দেশ দিয়ে ওয়াপদা বাঁধ ধরে পালিয়ে গেছে। পরে জানা গেল পাকিস্তানি সৈন্যরা ভেড়া কোলা হলদারদের নৌকায় বেড়া নদী পার হয়ে নগর বাড়ি হয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে পালিয়ে গেছে। সকালে দেখা গেল ওয়াপদা বাঁধের উপর দুই জন সাধারণ মানুষ যুদ্ধের সময়ে গুলি লেগে মারা গেছেন।
আমাদের পক্ষের বেশ কয়েক জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়েছেন। এস.এম আমির হোসেন ভাইয়ের গ্রুপের গুরুতর আহত দুই জন কে বেড়া হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। পরে জানা গেছে এস.এম. আমির হোসেন ভাইয়ের গ্রুপের জনাব মো: আব্দুল খালেক ও মো: আমজাদ হোসেন দুই জনই শহিদ হয়েছেন। ধীতপুর যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে আমাদের গ্রুপ জামিরতা হাই স্কুলে ক্যাম্প করে আশ্রয় নিলাম। ঐ দিনই অথার্ৎ ১৪ ডিসেম্বর শাহজাদপুর থানা হানাদার মুক্ত হলো।
লেখক : এই যুদ্ধের একজন যোদ্ধা।
মুক্তিযোদ্ধা পরিচিতি:—
বীর মুক্তিযোদ্ধা দেবেশ চন্দ্র সান্যাল,পিতা: দ্বিজেন্দ্র নাথ সান্যাল,মাতা: নিলীমা সান্যাল, গ্রাম ও ডাকঘর:রতন কান্দি,ইউনিয়ন:হাবিবুল্লাহনগর,উপজেলা:শাহজাদপুর, জেলা: সিরাজগঞ্জ।গেজেট নং—বে—সামরিক সিরাজগঞ্জ—১৬৭৯। ভারতীয় প্রশিক্ষণ — এফ.এফ. নং—৪৭৪২। সমন্বিত তালিকা জলা ভিত্তিক —১৪১১, উপজেলাভিত্তিক—১৫৮ মুক্তিযোদ্ধা পরিচিতি — ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিষ্টেম, ডিজিটাল সনদ ও পরিচয় পত্র নং— ০১৮৮০০০১৪১১।