“দুই মাসে খুন ধর্ষণের ঘটনা ৭৭৪”— চলতি বছরের ২৮ নভেম্বর যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের শিরোনাম। এ রকম একটা ঘটনা নয়, রেফারেন্সসহ কয়েকটা ঘটনা উল্লেখ করা যাবে। সেগুলো নাই-বা করলাম। সমস্যা নিয়ে যত কথা বলা হবে, তত সমস্যা বাড়বে বৈ কমবে না। তাই উচিত সমস্যার কারণ বিশ্লেষণ ও সমাধান নির্ধারণ করা। আমি কোনো বিশ্লেষক নই। তবুও নিজের সীমিত জ্ঞানে এই বিষয়ে কিছু আলোচনা করার চেষ্টা করব।
যৌন হয়রানি, ধর্ষণ এসব আজকালের ঘটনা নয়। সভ্যতার আদি থেকেই পুরুষের লালসার শিকার হয়ে আসছে নারীরা। এর কারণ নিরূপণ করা দুরূহ বিষয়। তবে সমাজ দোষ দেয় নারীকে। নারীর অশালীন পোশাক পরা, বাইরে যাওয়া এসব দেখে নাকি পুরুষের কাম জাগ্রত হয়, তারা নিজেকে সামলাতে না পেরে ধর্ষণ করে। এভাবে জাস্টিফিকেশান দেওয়া হয়। তবে মেয়েদের পর্দা করার গুরুত্বের সঙ্গে যে পুরুষের চোখের পর্দা করা সমান গুরুত্বপূর্ণ তা তো কেউ বলে না! আর নারীর অশালীন পোশাক যদি যৌন হয়রানির কারণ হয় তবে তিন চার বছরের বাচ্চার ধর্ষণ হওয়ার পিছনের কারণ কি? এসবের উত্তর চাইলে সবাই নিশ্চুপ হয়ে থাকে। এসব তর্ক বিতর্ক বাদ দিলাম।
এবার আসা যাক আমাদের সমাজ বিষয়টাকে কীভাবে দেখছে। ধর্ষণ বা যৌন হয়রানি প্রতিরোধ করার বিষয়ে কোনো তৎপরতা তো দেখাই যাচ্ছে না। বরং ধর্ষককে প্রটেক্ট করা হচ্ছে। কয়দিন আগে এক ধর্ষকের পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি সে নাবালক এই উছিলায়! ধর্ষক আবার নাবালক হয়? তাহলে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক যে, ধর্ষককে প্রটেক্ট করা হচ্ছে এখন সে সাবালক নয় বলে— তাকে ২/৩ বছর পর ছেড়েও দেওয়া হবে? অস্বাভাবিক কিছুই না। চার মাস একটা মেয়েকে আটকে রেখে নির্যাতন করে তাকে মেরেই ফেলল যে শয়তান, সে পার পেয়ে যাবে তথাকথিত ‘সাবালক নাবালক’ আইনের এখতিয়ারে!
আজ দেখলাম এক শিক্ষক তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ করেছে। কিন্তু মহামান্য সাংবাদিক মহাশয় ধর্ষকের মুখ ব্লার করে খবর প্রকাশ করেছেন। এখানে কি উছিলা? এই শিক্ষক নাবালক নাকি অতি বয়স্ক বলে সম্মানী? আহা কি নৈতিকতাবোধ দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়! অথচ এসবের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলছে না।
প্রশ্ন জাগে এসবের প্রতিরোধ করা যায় কীভাবে? কীভাবে আমাদের নারীদের নিরাপদে রাখা যায়? আমি বলব সোজা হাতে ঘি না উঠলে আঙুল বাঁকাতেই হবে। ধর্ষকের প্রতি কোনো সহানুভূতি দেখানো যাবে না।
ধর্ষণ একটি বিশ্বব্যাপী মহামারীতে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন দেশের আইন অনুসন্ধান করলে দেখা যায় ভারত, ইরান, চীন, গ্রিস, রাশিয়াসহ এশিয়া-ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। তবে যুক্তরাষ্ট্র, নরওয়েসহ উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি ৩০ বছর কারাদণ্ড।
এখন বাংলাদেশের আইন দেখা যাক, ‘বাংলাদেশ দণ্ডবিধি ১৮৬০’-এর ৩৭৬ ধারায় বলা হয়েছে। এই ধারায় ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এই ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি ধর্ষণের অপরাধ করে, তবে সে ব্যক্তি যাবজীবন কারাদণ্ডে অথবা ১০ বছর পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে, এবং তদুপরি অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবে, যদি না ধর্ষিতা স্ত্রীলোকটি তার নিজ স্ত্রী হয় এবং সেই স্ত্রী ১২ বছরের কম বয়স্কা না হয়।
এ ছাড়া, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ এর ৯ নম্বর ধারায়ও ধর্ষণের ঘটনায় সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের কথা বলা হয়েছে। তবে এ আইনে ধর্ষণের ফলে মৃত্যু হলে সে ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের কথা বলা আছে। ৯(১) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন, তাহা হইলে তিনি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন।
এরপর ৯(২) ধারায় আছে, যদি কোনো ব্যক্তি কর্তৃক ধর্ষণ বা উক্ত ধর্ষণ-পরবর্তী তাহার অন্যবিধ কার্যকলাপের ফলে ধর্ষিতা নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অন্যূন এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন। এ ছাড়া ৯(৩) ধারায় আছে, যদি একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন এবং ধর্ষণের ফলে উক্ত নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে বা তিনি আহত হন, তাহা হইলে ঐ দলের প্রত্যেক ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অন্যূন এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন। (৪) যদি কোনো ব্যক্তি কোনো নারী বা শিশুকে-(ক) ধর্ষণ করিয়া মৃত্যু ঘটানোর বা আহত করার চেষ্টা করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন।”
প্রশ্ন হচ্ছে এরপরও কি আইন সঠিকভাবে প্রয়োগ হচ্ছে? এসব নিয়ে কথা বলার আর অবকাশ নেই। এখন পরিস্থিতি ও নারীদের সুরক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের দাবি, “ধর্ষণের একমাত্র শাস্তি হবে মৃত্যুদন্ড। ধর্ষক সাবালক বা নাবলক বলে কোনো কথা নেই। সব ধর্ষকের শাস্তি হবে এক৷ ধর্ষণের বিচার প্রক্রিয়া সর্বোচ্চ দুই বছরের মধ্যে শেষ করতে হবে, যেন ধর্ষিতাকে বছরের পর বছর হয়রানির শিকার হতে না হয়।”
ধর্ষণের ঘটনা যেভাবে বাড়ছে এতে শাস্তির কঠোরতাই পারে এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে৷ এ ক্ষেত্রে কিছু দেশের আইনি ব্যবস্থা উল্লেখ করা হলো:
চীন
এশিয়ার বৃহৎ দেশ চীনে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনায় ধর্ষকের যৌনাঙ্গ কেটে দেওয়া হয়।
ইরান
এশিয়ার আরেক দেশ ইরানে সাধারণত ধর্ষককে জনসম্মুখে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে অথবা গুলি করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধর্ষিতার অনুমতি নিয়ে ধর্ষককে জনসম্মুখে ১০০ দোররা (চাবুক) মারা অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
গ্রিস
গ্রিসে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। আর এই শাস্তি কার্যকর করা হয় আগুনে পুড়িয়ে।
মিসর
মিসরে জনাকীর্ণ এলাকায় জনসম্মুখে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
এভাবে কঠোর না হতে পারলেও যদি কমপক্ষে পরপর দশটি ধর্ষণের মামলা অতি শীঘ্র বিচার শেষ করে, ধর্ষককে ফাঁসি দেওয়া হয় তবে ধর্ষণের হার কমে আসবেই। এবার আর মোমবাতি প্রজ্বলন করে মিছিল করে প্রতিবাদ জানানোর সময় নেই। সবাই যখন নিজেদের দাবি আদায় করছে। নারীরা আপনারাও আসুন আমাদের দাবি আমরা আদায় করে নিই।
বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে এই ভয়াবহ মহামারী “যৌন হয়রানী ও ধর্ষণ” প্রতিরোধ করা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সুস্থ নিরাপদ জীবন প্রত্যেক মানুষের জন্মগত অধিকার। তা নিশ্চিত করতে না পারলে কোনো জাতির উন্নতি সম্ভব নয়।
তাই ধর্ষককে সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে যেন লজ্জায় অনুতাপে সে শেষ হয়ে যায়। কিন্তু হয় উল্টোটা। ধর্ষক নির্ভীকভাবে ঘুরে বেড়ায়, আর সমাজ ধর্ষিতা ও তার পরিবারকে একঘরে করে দেয়। এবার আইনের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দরকার আমাদের মানসিকতা পরিবর্তন করা তবেই উন্নত বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্ন বাস্তব হবে।
লেখক: সেঁজুতি মুমু, সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় শাখা।
আরএস