সকাল ছয়টা ত্রিশ মিনিট। জুন মাসের এক ভোর। ‘সেভ ওয়াইল্ড লাইফ এন্ড নেচার’ -এর ফাহিমের ফোনে জরুরি কল। ওপারে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষার্থী মিনহাজের উদ্বেগ-ভরা কণ্ঠস্বর, প্রশাসনিক ভবনের সামনে পড়ে আছে একটি উজ্জ্বল সবুজ টিয়া। আহত। উড়তে পারছে না। মুহূর্তের বিলম্ব নেই। ফাহিম ছুটে গেলেন ঘটনাস্থলে। সেই বিপন্ন প্রাণটিকে রক্ষা করাই ছিল তার প্রথম কাজ। প্রাণপণ সেবা-যত্নে বাঁচল পাখিটি। দশ দিন পর সগৌরবে ছাড়া হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারিস রোডের এক উন্নত গগনশিরীষ গাছে। এ শুধু একটি পাখি উদ্ধারের গল্প নয়; এ যেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হৃদয়ে প্রাণের স্পন্দন রক্ষার এক প্রতীকী দৃশ্য।
বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই বিদ্যাপীঠ, ৭৫৩ একরের বিশাল আঙিনা, শুধু জ্ঞানের আলোই নয়, প্রকৃতির অফুরন্ত রহস্যেরও আধার। মতিহার তার সবুজ হাত বাড়িয়ে ডাকে, বোটানিক্যাল গার্ডেন সাজায় প্রকৃতির রঙ্গশালা। দুটি বড় লেক আর ছয়-সাতটি পুকুরের জলরাশি যেন ক্যাম্পাসের বুকে আঁকা নীলকান্তমণি। তুত বাগানের পাশের লেকে একসময় ভিড় করত দেশীয় পরিযায়ী পাখির দল, যদিও দিনে দিনে সে ভিড় কমছে। কিন্তু প্রকৃতির এই লীলাভূমি কি হার মানে?
সেভ ওয়াইল্ড লাইভ এন্ড নেচার, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যমতে জানা যায়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তুত বাগানের পাশের লেকটিতে প্রচুর পরিমাণে লোকাল মাইগ্রেট পাখি আসে। যদিও ধীরে ধীরে তা কমতে শুরু করেছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম বৃহৎ সামাজিক বনায়ন মতিহার উদ্যান৷ মতিহার উদ্যানে বিভিন্ন বিলুপ্তপ্রায় পাখি, প্রাণী পাওয়া যায়। এরমধ্যে অন্যতম বিলুপ্তপ্রায় পাখি, যা বাংলাদেশে মাত্র এক বা দুইবার বার রেকর্ড পাওয়া গেছে। এই পাখিটির নাম বাদামিচাঁদি কাঠকুড়ালি বা Dendrocopos nanus। এটি শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েই পাওয়া যায়। এছাড়াও সবুজ টিয়া যা মূলত গ্রামের ক্ষেতে খামারে থাকতো। তবে গ্রামের ক্ষেতগুলো থেকে তাদের তাড়িয়ে দিতো বিধায় তারা শহরের দিকে মাইগ্রেট হওয়া শুরু করে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারিস রোডের উঁচু উঁচু গগণশিরীষ গাছে তারা আশ্রয় নেয়। প্রতিবছর প্রচুর পরিমাণে বার্ড ওয়াচাররা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারিস রোডে আসে সবুজ টিয়ার ছবি তুলতে। প্যারিস রোডের এইসব উঁচু গাছে ভুবন চিলেরও বাসা রয়েছে।
প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. সালেহ রেজা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাখি নিয়ে একটি রিসার্চ করেন। যেখানে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যমান পাখিদের একটি লিস্ট তৈরি করেন। লিস্টে দেখা যায় প্রায় ১৫৯ প্রজাতির পাখির বসবাস রয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় জুড়ে। তন্মধ্যে বামুনি কাঠ শালিক (Chestnut-tailed Starling), ছোট কালি পেঁচা (Oriental Scops Owl), মেটে মাথা বাট কুড়ালি ((Brown-headed Barbet) এমন কিছু পাখি যা শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েই পাওয়া যায়। যা পুরো বাংলাদেশে একবারই রেকর্ড করা হয়েছে। ক্যাম্পাসে প্রচুর পরিমাণে রয়েছে বামুনী শালিক (Brahminy Myna)।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিষধর সরীসৃপের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় খৈয়া গোখরা, কালাচ। নির্বিষ সাপের মধ্যে রয়েছে জলঢোড়া, বেত আঁছড়া হেলে ইত্যাদি সাপ। এছাড়াও রয়েছে মেটে সাপ যা মৃদু বিষধর। গুইসাপের মধ্যে রয়েছে বেঙ্গল মনিটর এবং গোল্ডেন মনিটর। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ সাপই রেসকিউ করে পরবর্তীতে মতিহার উদ্যানে অবমুক্ত করা হয়।
সরিসৃপ বা পাখি ছাড়াও ক্যাম্পাসে শেয়াল, কাঠবিড়ালি, মেছো বিড়াল, গন্ধগোকুল বিভিন্ন প্রজাতির ব্যাঙ রয়েছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ কলাভবনের সামনে বসলেই দেখা পাওয়া যায় পাঁচ ডোরা কাঠবিড়ালি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এই কাঠ বিড়ালির অভয়ারণ্য বলা চলে। এরা বিভিন্ন বড় গাছের কোটরে থাকতে পছন্দ করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় শিক্ষার্থীদের সাথেই যেন এদের চলাচল। শিক্ষার্থীরাও এসব কাঠবিড়ালির লাফালাফি দেখে খুশি হয়ে যায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃৎশিল্প বিভাগের ১৭-১৮ সেশনের শিক্ষার্থী এবং সেভ ওয়াইল্ড লাইফ এন্ড নেচারের প্রেসিডেন্ট ইমরুল কায়েস বলেন, রাজশাহী পুরো বাংলাদেশের ৪৮ শতাংশ জীববৈচিত্র্য ধরে রেখেছে। আর রাজশাহীর ভিতরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় যেন একটি ছোট্ট অভয়ারণ্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও মেনে নিয়েছে তাদের চলাচল। আমরা যেকোনো রেসকিউ এর খবর শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেই পাই। কিন্তু আগে তারা এতোটা সচেতন ছিলো না। শিক্ষার্থীদের এই একটু সচেতনতাই পারে রাবির ওয়াইল্ড লাইফকে বাঁচাতে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক সালেহ রেজা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার ক্ষেত্রে নানাজনের নানা দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যদি প্রত্যেকদিন ক্যাম্পাসে ঘোরার সময় একটু আশেপাশে তাকায় তাহলেই বুঝতে পারবে এই প্রকৃতি তাদেরকে কতকিছু দিচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেও আমরা প্রতিনিয়ত বলে যাই যেন প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্ষতি না হয়। কিন্তু দেখা যায় প্রতিদিন ক্যাম্পাসে ৩০-৪০ হাজার মানুষ যাতায়াত করছে। বিকেল হলেই মানুষের ঢল নেমে যায়। কিন্তু পাখি, অন্য প্রাণীদেরও এই সময়টা বিশ্রাম প্রয়োজন। কিন্তু তারা তা পায় না। তাই সচেতনতাই শেষ সমাধান হিসেবে আমি মনে করি।
ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা যায় তারাও ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের অবাধ প্রবেশে বিরক্ত। অতিরিক্ত মানুষের সমাগম ক্যাম্পাসে জীববৈচিত্র্য নষ্ট করছে বলে তাদের ধারণা।
দিনশেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকলের একটাই আহবান প্রশাসনের প্রতি। শিক্ষার্থীরা চায়, ক্যাম্পাসের এই জীববৈচিত্র্য টিকে থাকুক এবং নির্মল ক্যাম্পাসে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলুক মানুষ, পশু পাখি সকলেই।