নানা আয়োজনের মধ্যদিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন হয়েছে। রোববার (৬ জুলাই) সকাল ১০টায় শান্তির প্রতীক সাদা পায়রা ও বেলুন উড়িয়ে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর উদ্বোধন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার।
‘প্রতিষ্ঠার ৭২ বছরে সৃজন, গবেষণা, নেতৃত্বে দেশ ও বিদেশে পথপ্রদর্শক’ -শীর্ষক প্রতিপাদ্য নিয়ে কর্মসূচির শুরুতে প্রশাসন ভবন-১ চত্বরে সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন হয়। এরপর জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন শিক্ষা উপদেষ্টা ও বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ হাসান নকীব।
পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্যের নেতৃত্বে এক আনন্দ র্যালি নিয়ে অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলে ক্যাম্পাসের গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো প্রদক্ষিণ করেন। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় আঙিনায় বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি শেষে তাজউদ্দীন আহমদ সিনেট ভবনে শীর্ষক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়।
আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার জাতীয় উন্নয়নে গুণগত শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা ও জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের প্রেরণা সংরক্ষণের তাগিদ দিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘যারা গুণগত পরিবর্তন চায়, তাদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে। জুলাই-আগস্টে শিক্ষার্থী-শ্রমিকসহ সর্বস্তরের মানুষ তাজা প্রাণ দিয়েছেন স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের ছোঁয়া এখনো আসেনি। ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী ও তাদের পোষা বুদ্ধিজীবীরা ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা চালিয়েছে। জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের ইতিহাস ও প্রেরণা ভূলুণ্ঠিত হতে দেওয়া যাবে না। যদিও আমাদের সীমিত সম্পদের কারণে শিক্ষায় পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব হয়নি। কিন্তু উচ্চতর দক্ষতা ও মানসম্মত শিক্ষা ছাড়া রাষ্ট্র পুনর্গঠন অসম্ভব।’
শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতির নেতিবাচক দিক ঢোকানো যাবে না। দলাদলি বা মেধা বিকিয়ে দিয়ে রাজনীতিকে প্রাধান্য দিলে নতুন দেশ গঠন সম্ভব নয়।এছাড়া শিক্ষার্থীদের অর্জন বিশাল, কিন্তু শিক্ষকদের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করা যাবে না। জনদুর্ভোগ সৃষ্টি না করে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে হবে।
এসময় প্রধান আলোচকের বক্তব্যে বিশ্ববিদ্যালয়েল ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আজাহারুল ইসলাম খান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ইতিহাস, অতীত ও বর্তমানের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন।
সভাপতির বক্তব্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সালেহ্ হাসান নকীব বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কী, কীভাবে কাজ কওে, সেটি জানা প্রত্যেকের জন্য জরুরি। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভালোভাবে চলছে না। বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিতে হলে শিক্ষার্থী ও সংশ্লিষ্টদের মধ্যে একটি অন্তর্দহ অনুভব এবং গবেষণা ও পাঠদানে আরও মানোন্নয়ন প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে অপরাজনীতির চর্চা, যা এখনও চলছে তা রোধ করতে হবে। এই প্রবণতা যদি সময়মতো রোধ করা না যায়, তাহলে আবারও পুরোনো সমস্যার মধ্যেই ফিরে যেতে হবে।
তিনি বলেন, বিশ্ববাজারে দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা থাকলেও বাংলাদেশের শ্রমশক্তির আত্মমর্যাদাবোধে ঘাটতি রয়েছে। সুইডেনের একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার ১০ হাজার ডলার পেলেও বাংলাদেশের কেউ একই কাজের জন্য ২ হাজার ডলার পেলেই খুশি হয়ে যায়। এই মানসিকতা পরিবর্তন না হলে, রাজনৈতিক হোক কিংবা অর্থনৈতিক—কোনো ক্ষেত্রেই টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়।
শিক্ষক নিয়োগ প্রসঙ্গে উপাচার্য বলেন, এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া, যেখানে বর্তমানে বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এর কারণও দৃশ্যমান। অসতর্কভাবে পুরোনো নীতির অনুসরণ করা হলে আবারও অনিয়ম ও সংকট তৈরি হবে। এই প্রেক্ষাপটে শিক্ষার্থীদের ও সংশ্লিষ্টদের এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে—তারা বিশ্ববিদ্যালয়কে সঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে চান, নাকি কিছু গোষ্ঠীস্বার্থে আটকে রাখতে চান।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্রান্তিকালে রয়েছে। আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সস্তা শ্রমিক তৈরির একটি ক্ষেত্র হিসেবে দেখা হচ্ছে। এই বাস্তবতায় আত্মমর্যাদা সম্পন্ন জাতি হিসেবে এটি একটি বিপজ্জনক পরিস্থিতি। তাই এখন প্রয়োজন গুণগত উৎপাদন, মৌলিক আবিষ্কার এবং বিশ্বমানের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর উপস্থিতি।
সভায় অন্যদের বক্তব্য দেন উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মাঈন উদ্দীন ও কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মতিয়ার রহমান।আলোচনা সভায় বিশ্বদ্যিালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিষ্ট্রার অধ্যাপক ইফতেখারুল আলম মাসউদ, প্রক্টর অধ্যাপক মাহবুবর রহমান, ছাত্র উপদেষ্টা আমিরুল ইসলাম, জনসংযোগ দপ্তরের প্রশাসক অধ্যাপক আখতার হোসেন মজুমদার-সহ প্রশাসনের বিভিন্ন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ, সিন্ডিকেট সদস্যবৃন্দ, অনুষদের ডিন, হল প্রাধ্যক্ষ ও বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা উপস্থিত ছিলেন।
আলোচনা সভার পূর্বে উপলক্ষে পতাকা উত্তোলন এবং বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর উদ্বোধন করা হয়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্যের নেতৃত্বে এক আনন্দ র্যালি নিয়ে অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলে ক্যাম্পাসের গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো প্রদক্ষিণ করেন।