সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধির দাবিতে আবারও আন্দোলন শুরু হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে একদল চাকরিপ্রত্যাশী এই দাবি জানিয়ে আসছে। তাদের দাবির প্রেক্ষিতে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত একটি কমিটি ছেলেদের জন্য চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর এবং মেয়েদের জন্য ৩৭ বছর করার সুপারিশ করেছে। এই সুপারিশ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় (বুটেক্স) এর কয়েকজন শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা যায় তাদের মতামত।
ওয়েট প্রসেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৪তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আহনাফ আবিদ বলেন, চাকরীর বয়সসীমা ৩০ বছরই যুক্তিযুক্ত। বরং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতো বাধ্যতামূলকভাবে ৩.৫-৪ বছরে অনার্স ও ১ বছরে মাস্টার্স শেষ করানো যায় সে ব্যবস্থা করা উচিত। না করতে পারলে বিশ্ববিদ্যালয়কে শাস্তির আওতায় আনা উচিত। যেমন: বাজেট বন্ধ করা, শিক্ষকদের প্রমোশন আটকে দেয়া। তাহলে অধিকাংশ শিক্ষার্থীর ২২-২৩ বছরের মাঝে অনার্স-মাস্টার্স শেষ হয়ে যাবে। সরকারি চাকরির জন্য ৭-৮ বছর সময় পাবে। চাকরির বয়স ৩৫ করা হলে একই ব্যাচে ৩৫ বছর বয়স্ক কেউ আবার ২৪-২৫ বছর বয়স্ক কেউ চাকরী পাবে যা অস্বস্তি তৈরি করবে। ৩৪-৩৫ বয়সেও কেউ চাকরি না পেলে তাকে এই বয়সে ফ্রেশার হিসেবে বেসরকারি চাকরিতেও নেয়া হবে না, স্টাডি গ্যাপ জন্য বিদেশে যাওয়ার সুযোগ থাকবে না। সুতরাং তখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক পদ, বিভিন্ন স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সুপারিশ অথবা টাকার বিনিময়ে চাকরি নেয়ার চেষ্টা করবে যা চাকরির বাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলবে এবং অসম প্রতিযোগিতা তৈরি করবে।
ফেব্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলাম আকাশ এ সম্পর্কে বলেন, ৭২ বছর গড় আয়ুর দেশের মানুষের কর্মক্ষেত্রে ঢুকার বয়স যখন আপনি করেন ৩৫ কিংবা ৩৭, ব্যাপারটা কোনোভাবেই যৌক্তিক হতে পারে না। জীবনের অর্ধেক সময়ই কর্মহীন হয়ে কাটানো মানুষদের একদিকে যেমন বেকারত্বের গ্লানি যেমন বইতে হয়, তেমনি কমে যায় কর্মক্ষমতাও। এর বদলে আরোও বেশি চাকুরীর সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে, কারিগরী শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সেশনজট দূর করতে হবে। সঠিক সময়ে যাতে শিক্ষার্থীরা কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে পারে সেটা নিশ্চিত করতে হবে। চাকরির বয়সসীমা বৃদ্ধি নয় বরং সকলের জন্য সঠিক সময়ে যোগ্যতানুসারে সঠিক চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করাটাই হবে দেশের কর্মক্ষমগোষ্ঠী তৈরি ও বেকারত্ব নিরসনের সঠিক সমাধান।
ওয়েট প্রসেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আলভী সালমান চাকরীর বয়স সম্পর্কে গঠনমূলক আলোচনা করেন। তিনি বলেন, ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে বয়সসীমা বৃদ্ধির ইতিবাচকতার চেয়ে নেতিবাচকতার পাল্লাটা ভারী বলে মনে হয়। নেতিবাচকতা কেন্দ্রিক বেশ কিছু আলাপ আসে। সরকারী চাকরি কেন্দ্রিক বর্তমানে যে বায়াসনেস কাজ করে সেটাকে আরও ওভারহাইপড করে। ধরুন, একজন ৩৫ বছর বয়সে নবম গ্রেডের কোনো চাকরি পেল। সাধারণত ৩৫ বছর বয়সসীমায় এদেশে সবার একটা নিজস্ব পরিবার থাকে। নবম গ্রেডের পে স্কেলে একটা পুরো পরিবারের ফিন্যান্সিয়াল দায়ভার নেওয়ার সক্ষমতা কতটুকু? এর সদুত্তর হলো সক্ষমতা নেই। এক্ষেত্রে বাজে আউটকাম স্বভাবতই চলে আসে সেটা হলো দুর্নীতির প্রবণতা। আমার মনে হয় একজন মানুষের অন্যতম একটা স্কিল হলো কখন কোনোকিছু ‘ছেড়ে দিতে হবে ‘ এটা বুঝতে পারা। ওভারহাইপড কোনো কিছু ছেড়ে দেওয়ার প্রবণতা মানবজাতির বরাবরই কম। তাই সিস্টেমের আসলে এ জায়গায় সাহায্য করাটা দরকার। কিন্তু এক্ষেত্রে সিস্টেমই এই লুপের মধ্যে ধরে রাখছে। একে তো ঐ মানুষটার জীবনীশক্তি শুষে নেওয়া হচ্ছে। উপরন্তু কেউ যদি ব্যর্থ হয়, তার আসলে আর ফেরার পথটা থাকে না। এ সময়টায় এসে ব্যবসায় নতুন উদ্যোগ নেওয়ার মানসিক শক্তিটা কতটুকু বেঁচে থাকে? এর উত্তরও নেতিবাচকই দাঁড়ায়। ইতিবাচকতা নিয়ে আলাপ করা যায়। মোটাদাগে ইতিবাচকতা এই জায়গাতে যে সবাই একটা সময় পাচ্ছে।তাই একদম হুমড়ি খেয়ে না পড়ে এমন সুযোগ তৈরী হয়তো হতে পারে যে অনেক নানা রকম ক্যারিয়ার প্যাথ ট্রাই করলো সেটাতে সফলতা বা সুবিধে করতে না পারলে তার জন্য একটা সুযোগ থেকে যাচ্ছে সরকারি চাকরিতে আসার। আমার খুব কল্পনা পায় এ জায়গাতে যেসব ছাত্র দেশের বাইরে চলে গেছে তাদের দু-চারজন হয়তো ফিরতে পারে। কিন্তু পে স্কেল অনুযায়ী সেটা নিতান্ত কল্পনাই হয়তোবা।
একই বিভাগের ৪৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মোফাখতার জামি বলেন, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ছেলেদের জন্য ৩৫ এবং মেয়েদের জন্য ৩৭ বছর করার সুপারিশ যথাযথ ও সময়োপযোগী। করোনার কারণে নিয়োগ প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন স্থবির ছিল, যা শিক্ষার্থীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত করেছে। পাশাপাশি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধজনিত অর্থনৈতিক সংকটও চাকরির বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।মেয়েদের ক্ষেত্রে বয়সসীমা ২ বছর বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে আমি মনে করি ১ বছর বাড়ানোই যথেষ্ট হতো। কারণ সামাজিক ও পারিবারিক বাধার ফলে মেয়েরা অনেক সময় শিক্ষা ও চাকরির সুযোগ থেকে পিছিয়ে পড়ে। তবে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর পাশাপাশি অবসরের বয়সসীমা পুনর্বিবেচনা করাও জরুরি। সব মিলিয়ে এই সুপারিশ শিক্ষার্থীদের জন্য ন্যায্য সুযোগ তৈরি করবে এবং চাকরির বাজারকে আরও প্রসারিত করবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
অ্যাপারেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী নাজমুস সাকিব অয়ন বলেন, আমি ছাত্র হিসেবে মনে করি চাকরির বয়স বাড়ানো উচিত। তবে সেটা ৩৫ না করে ৩২ এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা। সরকারের উচিত চাকরির বয়স বাড়ানোর সাথে সাথে দেশের তরুণ প্রজন্মকে উদ্যোক্তা হতে উদ্বুদ্ধ করা এবং এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। উদ্যোক্তা হয়ে আরও কয়েকজনের কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করতে পারে সেরকম মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। পরিশেষে এটাই বলতে চাই চাকরির বয়স ৩২ অবধি করে তরুণ প্রজন্মকে চাকরির পাশাপাশি উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে সরকারের উদ্যোগ নেওয়া উচিত।