এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ক্লাস আর পরীক্ষার পর একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস। সামনে শুধু ভাইভা। এরপরই পাড়ি দিবেন স্বপ্নের আরও একটি ধাপ। কিন্তু সেই স্বপ্ন আর পূরণ হলোনা! তাঁদের আনন্দভ্রমণ আর ফিরে আসেনি। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ে থেমে গেছে তিনটি তরতাজা প্রাণ। নিভে গেছে তিনটি পরিবারের আশার আলো, হারিয়ে গেছে সম্ভাবনার দিগন্ত।
গত মঙ্গলবার ভোর সাড়ে ৫টার দিকে কক্সবাজারের হিমছড়ি সমুদ্র সৈকতে গোসল করতে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের তিনজন শিক্ষার্থী। তাঁদের মধ্যে কে. এম. সাদমান রহমান সাবাবের মরদেহ উদ্ধার করে মর্গে পাঠানো হয়েছে। অন্যদিকে আজ সকালে ভেসে উঠেছে আসিফ আহমেদের মরদেহ। অরিত্র হাসান এখনো নিখোঁজ। ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি টিম ও ট্যুরিস্ট পুলিশ উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছে। সমুদ্র উত্তাল হওয়ায় ব্যাহত হচ্ছে উদ্ধার কাজ।
নিখোঁজ তিনজনের সাথে ছিলো আরও দুইজন সহপাঠী মো. ফারহান ও রিয়াদ। ফারহান বলেন, আমাদের মূলত বান্দরবন যাওয়ার প্ল্যান ছিল। পরে কক্সবাজারে চলে আসি। আমাদের সাগরে নামার পরিকল্পনা ছিল না। কিন্তু সাবাব হঠাৎ নামলে অরিত্র আর আসিফও নেমে পড়ে। ঢেউ প্রথমে তেমন ছিল না, পরে বড় ঢেউ আসতেই তারা চেষ্টা করেছিল উঠে আসার কিন্তু পারেনি! সেই মুহূর্তটি যেন আমার চোখে স্থির হয়ে গেছে। ঢেউয়ের ধাক্কা, আর অসহায়ভাবে সাগরের দিকে তাকিয়ে থাকা সব মিলে এটি আমার এক আজীবন দুঃসহ স্মৃতি। আল্লাহ তাঁদের ওপারে ভালো রাখুক।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক ও সহকারী প্রক্টর সাঈদ বিন কামাল চৌধুরী বলেন, পরীক্ষা শেষ হওয়ায় তাঁরা ব্যক্তিগতভাবে কক্সবাজারে ঘুরতে গিয়েছিল। নিখোঁজের পরপরই সাবাবের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। আজ আসিফের লাশ সমিতিপাড়া এলাকায় ভেসে এসেছে। কিন্তু অরিত্র এখনো নিখোঁজ।
তাঁরা তিনজনই বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মো. ফরহাদ হোসেন হলের একই রুমের আবাসিক শিক্ষার্থী। সাবাবের বাড়ি ঢাকার মিরপুরে, বাকি দুইজনের বাড়ি বগুড়ায়। ক্যাম্পাসের পাঠ চুকিয়ে পরিবারের হাল ধরবে ছেলে, সেই আশায় বুক বেধে থাকা বাবা-মাকে জানানো হয়েছে ছেলের মর্মান্তিক মৃত্যুর খবর। পাগলপ্রায় বাবা-মা ছুটছেন ছেলের খোঁজে।
তিন শিক্ষার্থীকে হারিয়ে শোকে মাতম পুরো বিশ্ববিদ্যালয়। উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন বলেন, এটা একটি হৃদয়বিদারক ঘটনা। তাঁদের হারিয়ে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার শোকাহত। আমরা ঘটনা জানার পর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি গাড়ি পাঠিয়েছি এবং সেখানকার প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে। তাঁরা পরীক্ষা শেষ করে নিজ উদ্যোগে সেখানে ঘুরতে গিয়ে এই দুর্ঘটনায় পড়েছে। আমি শিক্ষার্থীদের বলবো তাঁরা যেন সতর্ক হয়ে চলে। আর নিহত পরিবার আল্লাহ ধৈর্য ধরার তাওফিক দান করুক।
পরীক্ষা শেষে একটুখানি প্রশান্তির খোঁজে ক্যাম্পাস ছেড়েছিল এই তিন তরুণ। কিছুটা একঘেয়েমি কাটিয়ে হয়তো ফিরেই আবার ভাইভা দেবেন, বই খুলবেন, ভবিষ্যতের পরিকল্পনায় মগ্ন হবেন এই ছিল তাঁদের ভাবনা। স্বপ্ন ছিল, সম্ভাবনা ছিল, সামনে এগিয়ে যাওয়ার দুরন্ত আকাঙ্ক্ষা ছিল। কিন্তু সে ফিরেই আর আসা হলো না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস নিঃশব্দ, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের করিডোর নিস্তব্ধ। কোনো এক শূন্যতা গ্রাস করেছে। সহপাঠীদের চোখে পানি, তিনটি চঞ্চল তরুণ প্রাণের অনুপস্থিতি যেন ছায়া ফেলেছে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে।